বিশেষ প্রতিনিধি: মূল্যহীন ভেবে একসময় বেলের খোসা ফেলে দেয়া হতো। এখন আর তা ফেলনা নয়। কারণ বেলের খোসা থেকেই তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের নান্দনিক মালা। আর এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালী ইউনিয়নের তিন শতাধিক পরিবার।
শুধু দেশের ভেতরেই কদর নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, চীন ও জাপানেও রফতানি হচ্ছে নান্দনিক বেলের মালা।
বেলের খোসা থেকে দূরবীন (বিশেষ একধরনের যন্ত্র) দিয়ে ছোট ছোট পুঁথি বা দানা কেটে সুতায় ভরে তৈরি করা হচ্ছে নানা রঙের নান্দনিক মালা। এখানকার দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন এসব মালা তৈরির কাজ। তাই বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে শিল্পটি।
মহম্মদপুর ইউনিয়নের বহলবাড়িয়া, কুলিপাড়া, ধূলজোরা, চরশালামতপুর, বৃহশনগর, চুড়ারগাতি, কাওয়ালিপারা, শ্রীফলতলা, বাইচচর, ধুনচিয়া গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবার এ কাজে জড়িত। তবে আগে পাঁচ শতাধিক কারিগর যুক্ত ছিলেন এ পেশায়। কিন্তু কাঁচা বেলের সংকট আর লাভ কম হওয়ায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন অনিশ্চিত এ পেশা।
প্রায় ৭০ বছর আগে এখানে বেলের খোসা থেকে মালা তৈরির কাজটি শুরু হয়েছিল, যা শুনতে গল্পের মতো মনে হয়। ৮৫ বছর বয়সী সুনীল মন্ডল বলেন, নদীভাঙনের কারণে এখানে আগে সে রকম কোনো ফসল ফলত না। এখানকার মানুষ একসময় বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। হঠাৎ আমাদের এলাকার নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস ও ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস স্নান করার সময় নদীর পানিতে বেলের খোসা ভেসে যেতে দেখে তা তুলে এনে মালা তৈরি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অনুষ্ঠানে বিক্রি করেন। সেই থেকে শুরু হয় বেলের খোসা থেকে মালা তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে তা দুজন-পাঁচজন করে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় মালা তৈরির কাজ শিখে ফেলে সবাই।
আগে শুধু ধর্মীয় কাজে এই মালা ব্যবহৃত হতো। তবে কালপরিক্রমায় মাগুরার মহম্মদপুরে মধুমতি নদীভাঙনের শিকার এই এলাকার হতদরিদ্র মানুষের হাতের তৈরি বেলের খোসার মালা এখন সারাদেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ও গার্মেন্টসে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে এই মালা। এটি এখন শিল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে।
এ শিল্পের মহাজনরা জানিয়েছেন, দেশের মধ্যে শুধু মাগুরার মহম্মদপুরের এই গ্রামগুলোতেই তৈরি করা হয় বেলের মালা। বাংলাদেশের আর কোথাও এই শিল্প এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। তবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প আরও বড় করা সম্ভব।
মাগুরায় কাঁচা বেলের সংকট থাকায় নড়াইল, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে কাঁচা বেল ও বেলের খোসা কিনে আনা হয়। এরপর প্রক্রিয়াজাত করে দূরবীন দিয়ে এবং বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে বেলের খোসা থেকে ছোট ছোট দানা বা পুঁথি তৈরি করা হয়। তারপর তা সুতায় ভরে বিভিন্ন ধরনের রং দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের মালা তৈরি করা হয়।
এমন একজন কারিগর চুড়ারগাতি গ্রামের সুবোধ চন্দ্র মন্ডল। তিনি বলেন, কয়েক যুগ ধরে আমাদের এলাকায় বেলের মালা তৈরির কাজ হচ্ছে। আমিও প্রায় ৫০ বছর ধরে এই মালা তৈরির কাজ করছি। আগে মালা তৈরিতে পাঁচ শতাধিক কারিগর এলাকায় ছিলেন। কিন্তু কাঁচা বেলের সংকট ও লাভ কম হওয়ায় এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিনি আরও বলেন, এই মালা বাংলাদেশের আর কোথাও তৈরি হয় না। শুধু আমাদের এলাকার মানুষ এটা তৈরি করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
চরশালামতপুর গ্রামের বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, এক বস্তা কাঁচা বেল আমরা ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকায় বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসি। প্রতি বস্তায় প্রায় ২৫০টি বেল থাকে। একটি বেলের খোসা দিয়ে অন্তত ৫টি মালা তৈরি করা সম্ভব। প্রকারভেদে প্রতি গোছা মালা আমরা ৬০ থেকে ৭০ টাকায় মহাজনদের কাছে বিক্রি করে থাকি। তারা সেগুলো লাভে দেশের ভেতরে বিভিন্ন জেলায় এবং বিদেশে বিক্রি করে থাকেন।
কাওয়ালী পাড়ার নয়ন তারা শিকদার বলেন, আগে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এই কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন আমি ও আমার স্বামী এই কাজ ককরছি, ছেলেমেয়েদের বইখাতাসহ যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের উন্নত মেশিনপত্র কেনার জন্য ঋণ দিত, তাহলে আরও ভালো মানের মালা বানানোর কাজ করতে পারতাম।
চরশালামতপুর গ্রামের মালার কারবারি (মহাজন) রামপ্রসাদ বিশ্বাস বলেন, এসব এলাকায় কারিগররা বেলের খোসা থেকে যেসব মালা তৈরি করেন, আমি তা কিনে নিয়ে নিজেই দেশে ৩৬টি জেলায় বিক্রি করে থাকি। এক পোন (৮০টি) মালা আমি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় কিনে ৪৮০ বা ৪৯০ টাকায় বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, যারা মালা তৈরি করেন, তারা অধিকাংশই দরিদ্র। তাই প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে মালা তৈরির জন্য অগ্রিম টাকাপয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি। সরকার যদি স্বল্প বা বিনা সুদে এদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করত, তাহলে হয়তো এরা আরও ভালোভাবে এই শিল্পটাকে সমৃদ্ধ করতে পারত।
এই মালা দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা, ফ্যাশন হাউসে বিক্রি হচ্ছে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, চীন ও জাপানে বিক্রি হচ্ছে, এমনটা জানান তিনি।
দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাস নামে আরেকজন মহাজন বলেন, বর্তমান সময়ে স্যুট ও কোটের বোতামগুলো বেলের খোসা থেকে তৈরি হচ্ছে। আমাদের এলাকার কারিগররাই এখন সেগুলো তৈরি করছেন। আমি তাদের কাছ থেকে এসব মালা কিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দিয়ে থাকি।
বিসিক মাগুরা অঞ্চলের উপপরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, এই শিল্পকর্মটি টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি। কারণ, এই শিল্পের মাধ্যমে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। তারা যদি আমার কাছে আসেন, তাহলে আমি তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করব এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করব, এই শিল্পকে আরও উন্নত করতে এবং যাতে কারিগরদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।