এ্যান্টনি অপু
গত মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ভোরে গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের ফরিদপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের মৃত করিম বকশোর ছেলে খাইরুল ইসলাম (২৮)। খাইরুল যশোর শহরের আব্দুর রাজ্জাক কলেজ থেকে বিএ ও এমএম কলেজ থেকে এমএ পাস করেন। নিজের আত্মহননের আগে মোবাইলে নিজ কর্মস্থলের মালিককে দোষারোপ করে ভিডিও রেকর্ড করে। সেটি মাসুদ শেখ নামে তার এক বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান খাইরুল। সে ভিডিও বার্তা শোনার পর আলোচনা ঝড় উঠেছে গোটা এলাকায়।
খাইরুল গ্যাস ট্যাবলেট খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের স্বজনরা তাকে নিয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিন সকাল ৯টার দিকে মারা যান খাইরুল। তবে আত্মহননের কারণ জানতেন না বন্ধু মাসুদসহ নিহতের পরিবারের স্বজনরা। পরবর্তীতে ভিডিওটি বন্ধু মাসুদসহ সকলের নজরে আসে।
আত্মহত্যার আগে নিজের ফোনের রেকর্ড করা খাইরুলের এক মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ফুটেজটি বন্ধুসহ এলাকাবাসীর নিকট ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভিডিওতে খাইরুল বলেন, ‘সুন্দর এ পৃথিবী ছেড়ে কেউ যেতে চায় না, কিন্তু কিছু মানুষের কারণে এই অল্প বয়সে এই পৃথিবী ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। আমি গত চার মাস ধরে নতুনহাটের শুভ ইলেক্ট্রিক নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করছি। এই কোম্পানিটা মুকুল নামে একজনের। কেউ কেউ তাকে তারেক নামেও চেনে। এই লোকটা আমার কাছে অনেক টাকা দাবি করছে, বলছে আমি তোর কাছে টাকা পাই। সে আমার সব ডকুমেন্টস নিয়ে নিয়েছে, বলেছে পরে দেব। সে আমাকে অনেক হুমকি দিয়েছে, অনেক প্রেসার দিয়েছে। সে আমার কাছে কোন টাকা, বা নগদ অর্থ, মালামাল কিছুই পায় না। আমি গতকাল চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার মৃত্যুর জন্য শুভ ইলেক্ট্রিকের ওই লোক দায়ী। আমার মৃত্যুর পরে ওই লোক যেন আমার পরিবারের কাছে কোন অর্থ দাবি না করে এজন্য আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমার এলাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
বৃহস্পতিবার খাইরুলের বাড়িতে গেলে দেখা যায় এঘটনায় বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী। সঠিক তদন্ত করে খাইরুলের আত্মহত্যার পেছনে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তার স্বজন ও এলাকাবাসী।
খাইরুলের ভাই মাজেদ জানান, খাইরুল আত্মহত্যার আগে একটি ভিডিও করে তার বন্ধু এবং সম্পর্কে চাচাতো ভাই মাসুদের ফোনে পাঠায়। লাশ যখন হাসপাতালে তখন আমরা ভিডিওটা আমাদের নজরে আসে এবং আমরা তখন পুলিশ সদস্যদের জানালে তারা লাশের ময়নাতদন্ত করে। খাইরুল তার ভিডিওতে নতুনহাট বাজারের শুভ ইলেক্ট্রিক নামের একটি দোকানের মালিক মুকুলকে দোষারোপ করেছে।
খাইরুলের ভাই আরও বলেন, খাইরুল কখনো এসব বিষয়ে আমাদের সাথে বা পরিবারের কারও সাথে বলেনি। সে তার নোয়া ভাইয়ের বাসায় থাকতো, আলদা খেতো। সে কোথায় চাকরি করে তাও বলেনি। আমরা বাসায় তার সার্টিফিকেট গুলো খুঁজে পায়নি এবং খাইরুল বেঁচে থাকতে সেগুলো চাইলেও সে দেয়নি। আমার ভাইয়েরা মামলা করবে, আইনের দারস্থ হবে।
খাইরুলের ভাবি মিম বেগম বলেন, মৃত্যুর পিছনে যারা জড়িত আমরা স্বজনরা তাদের বিচার চাই।
খাইরুলের চাচাতো ভাবি স্বপ্না বেগম বলেন, খাইরুল অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিল, একটা টাকাও বাজে খরচ করতো না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। ও কোন টাকা পয়সা নিয়ে নয়ছয় করতে পারে না, ওরে ফাসিয়ে ব্লাকমেইল করেছে। ওকে নাকি হুমকি ধামকিও দিয়েছে।
খাইরুলের বন্ধু ও সম্পর্কে চাচাতো ভাই মাসুদ বলেন, সে (খাইরুল) যেদিন মারা যায় ওদিন ভোরে আমার ফোনে ভিডিওটি পাঠায়। কিন্তু ওতো ভোরে ঘুম থাকায় আমি খেয়াল করিনি। পরে ওর আত্মহত্যার খবর শুনে ওর লাশ নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একপর্যায়ে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ওই ভিডিওটি আমার নজরে আসে। তখন আমি ওর স্বজন এবং এলাকাবাসীদের দেখাই।
অভিযোগের বিষয়ে নতুনহাট বাজারের শুভ ইলেক্ট্রিকের মালিক মূকুল বলেন, খাইরুল আত্মহত্যা করেছে এটা শুনেছি। এবং আত্মহত্যার আগে একটি ভিডিওতে সে আমাকে দোষারোপ করেছে সেটাও শুনেছি। তবে কি কারণে সে আমাকে দোষারোপ করলো সেটি আমি জানি না। আমি তো ওর সাথে কোন অন্যায় করিনি। এটাই আমার কাছে বড় দুঃখের বিষয়।’
অভিযুক্ত মুকুল আরও বলেন, খাইরুল মূলত শেখ ফরিদ মার্কেটিং নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করতো। ওই কোম্পানির থানা ম্যানেজার মুজাহিদের মাধ্যমে খাইরুলের সাথে পরিচয়। খাইরুল শুধু আমার দোকান থেকে মালামাল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ডিস্ট্রিবিউট করতো। আমি ওর কাছে কোন টাকা পাবো না। বরং ও আমার কাছে এক হাজার টাকা পেত সেটি আমি দিতে চাইলে সে আমাকে বলে আমি আর চাকরি করবো না আমাকে ক্লিয়ারেন্স দেন। তখন আমি বললাম, আমি তো তোমাকে নিয়োগ দেইনি তোমাকে তোমার কোম্পানি ক্লিয়ারেন্স দেবে।
অভিযোগের ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, খাইরুলের সাথে আমার কোনদিন কোন তর্কাতর্কিও হয়নি। আশপাশের কোন দোকানদারও বলতে পারবে না। খাইরুল একটু এবনরমাল মতো ছিল, যেমন তেমন করে আমার দোকানের সামনে এসে রাস্তায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমরা অনেকবার তাকে সতর্ক করেছি যে তুমি এমন হেলাফেলা করে চলাফেরা করে চলাচল করলে দুর্ঘটনা ঘটবে।
এবিষয়ে শেখ ফরিদ মার্কেটিং কোম্পানির থানা সেলস্ ম্যানেজার মুজাহিদকে একাধিকবার তার ব্যাবহৃত একাধিক নাম্বারে কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, আত্মহত্যার ঘটনায় নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।