যশোর শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ পদে রদবদল হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর ড. আহসান হাবিব। সম্প্রতি বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যানের সাথে আলাপচারিতায় মিলিত হন দৈনিক কল্যাণের প্রধান প্রতিবেদক সালমান হাসান ও মফস্বল সম্পাদক সুনীল ঘোষ।
* বোর্ডের কর্মচারি ইউনিয়ন দুটিকে ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগাতেন অতীতের চেয়ারম্যানরা, একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিতেন? যার কারণে একটি মামলায় বোর্ডের সিবিএ নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে, এক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কি?
চেয়ারম্যান : কর্মচারীদের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব ছিলো। কর্মরতদের মধ্যে ঐক্যের অভাব প্রতিষ্ঠানের জন্য সুখকর নয়। এতে প্রতিষ্ঠান গতিশীলতা হারায়। তাই যোগদানের পর তাদের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছি। পুরোপুরি সক্ষম না হলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছি বলে মনে করি। আগের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কেউ কেউ হয়তো একপক্ষকে কাছে টেনে নিতেন। এতে অন্যরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন। আমি মনে করি এখানকার দুটি ইউনিয়ন আমার দুটি হাত। তারা সহযোগিতা করলে প্রতিষ্ঠানে আসা সেবাগ্রহীতারা উপকৃত হবেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক যে উদ্দেশ্য সেটি সফল হবে। এছাড়া আগে সিবিএ কার্যালয়ের সামনে নাম ফলকে ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়নের নাম লেখা থাকতো। এখানে যোগদানের পর কর্মচারিদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে উভয়ের সম্মতিতে অতীত দিনের এই চর্চা বন্ধ হয়েছে। নির্দিষ্ট কোন সংগঠনের নাম লেখা নেই এখন সিবিএ কার্যালয়ের সামনে। মামলার বিষয়টি একটি সমাধানের পর্যায়ে, এটি সম্পন্ন হলে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।
* যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি পাচ্ছেন না, টাকার বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যরাও প্রমোশন পেয়েছেন, এক্ষেত্রে আপনার প্রশাসন কেমন ভূমিকা রাখবে?
চেয়ারম্যান : পদোন্নতির ব্যাপারে কর্মরতদের অনেকের মধ্যে হতাশা আছে। যোগ্য হওয়ার পরও যথা সময়ে প্রমোশন যারা পাননি তাদের ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে। যোগ্যতা থাকার পরও নানা কারণে পদোন্নতি দেয়া হয়নি অতীতে এরকম অনেক অভিযোগ আছে। এবার সেরকমটি কিছু হতে দেয়া হবে না। কারণ পদোন্নতি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাদের কাজের প্রতি উৎসাহ যোগায়। হতাশা থাকলে কর্মস্পৃহা থাকে না। ফলে হতাশ কর্মীদের দিয়ে এত বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেবাদান সম্ভব না। যোগ্যদের কেউ পদোন্নতি বঞ্চিত হবেন না।
* বাইরের কেউ যশোর শিক্ষা বোর্ডে চাকরির সুযোগ পায় না, নিয়োগ হয় বংশপরম্পরায়। আপনার মেয়াদকালে নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন হবে?
চেয়রম্যান : যশোর শিক্ষা বোর্ডে বিভিন্ন পদের সংখ্যা কমবেশি ২১২। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৩২। প্রতিষ্ঠান আরো গতিশীল করার স্বার্থে শুন্যপদে নিয়োগের ব্যপারে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পর্যায়ের সাথে আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুন্যপদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছ হবে। যোগ্যরা শিক্ষা বোর্ডে নিয়োগ পাবেন।
* বোর্ডের আইনী পরামর্শক থাকার পরও বাইরের আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শোকজের মত ঘটনা ঘটেছে, বর্তমানে লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের পদ শুন্য রয়েছে। এব্যপারে আপনার পরিকল্পনা কি?
চেয়ারম্যান : শিক্ষা বোর্ডের একজন লিগ্যার অ্যাডভাইজার ছিলেন। যেকোন কারণে ওই পদে এখন কেউ নাই। তবে একজন লিগ্যাল অ্যাডভাইজার নিয়োগের ব্যপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বোর্ড কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রাতিষ্ঠানিক কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্তর হলো বোর্ড কমিটি। এটির সভায় লিগ্যাল অ্যাডভাইজার নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারে অতীতে পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেয়া হোত। এবার সে রকমটি হচ্ছে না। আইনী পরামর্শক নিয়োগের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেটি হলো লিগ্যাল অ্যাডভাইজার সার্চ কমিটি। শিক্ষা বোর্ডের সচিব এই কমিটির আহবায়ক থাকবেন। এছাড়া যশোর কোর্টের গর্ভমেন্ট প্লিডার (জিপি), পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও যশোর আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এই সার্চ কমিটিতে থাকবেন। তারাই শিক্ষা বোর্ডের জন্য যোগ্যতম লিগ্যাল অ্যাডভাইজার নির্বাচন করবেন। অতীতের মতন পছন্দের লোক ও আত্মীয় হওয়ার সুবাদে ওই পদে নিয়োগের সুযোগ থাকছে না। লিগ্যাল অ্যাডভাইজার নিয়োগের ব্যাপারে পত্রিকায় ঘোষণা দেয়া হবে। সার্চ কমিটি যাকে নির্বাচিত করবেন তিনি নিয়োগ পাবেন। বোর্ডের যেকোন আইনগত ব্যবাপারে পরামর্শ দেবেন তিনি।
* শিক্ষা বোর্ডে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকে নিয়মিত অফিস করেন না। এটি বন্ধে কোন পরিকল্পনা আছে কি?
চেয়ারম্যান : দীর্ঘদিন ধরে অফিস ফাঁকির একটি প্রবণতা চলে আসছিলো। দেরিতে আসার পরও চায়ের দোকানে, ক্যান্টিনে ও গ্যারেজের সামনে আড্ডা চলতো। অনেকেই আবার অফিস ছুটির আগে চলে যেতেন। দুপুরের খাবার খেতে গেলেও সময় মতো অফিসে ফিরতেন না। ফলে বোর্ডে সেবা নিতে আসা শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়তেন। এব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে আসতে হচ্ছে। বিকেল ৫টায় অফিস থেকে যেতে হচ্ছে। কর্মরতদের কেউ যদি তিনদিন নির্ধারিত সময়ে অফিসে না আসেন তাহলে একদিনের বেতন কাটা হবে।
* চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের টাকা উদ্ধারে প্রতিষ্ঠানগতভাবে কোন মামলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কি?
চেয়ারম্যান : চেক জালিয়াতির ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগতভাবে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে করণীয় নিয়ে আইনজীবীদের মতামত নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে একাধিক আইনজীবীর পরামর্শ নিয়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে মামলা করেছে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। তাই আদালতে একটি মামলা চলমান থাকায় নতুন আর কোন মামলার দরকার নেই বলে মতামত দিয়েছেন আইনজীবীরা।
অডিটে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়লে বোর্ডের পক্ষ থেকে মামলার জন্য আদালতে যাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু মামলা করা যায়নি। পরবর্তীতে বোর্ডের পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন পেয়ে তদন্তে নামে দুদক। জালিয়াতি ঘটনার সত্যতা থাকায় তদন্তে শেষে দুদকের যশোর জেলা কার্যালয় আদালতে মামলা করে।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করণীয় নির্ধারণে পরামর্শক কমিটি গঠন হয়েছে। বোর্ডের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি আর্থিক দুর্নীতির ওই ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অতিরিক্ত আরো কিছু করণীয় আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজনে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে। যাতে তাদের মতামতের ভিত্তিতে আইনগত অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
* অর্থ আত্মসাতে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকারকারী হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে বিভাগী কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না কেন?
চেয়ারম্যান : হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম অর্থ আত্মসাতে সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রমাণীত। তিনি নিজে থেকেই জালিয়াতিতে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। দুই ধাপে কিছু টাকাও ফেরত দিয়েছেন। তাই এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে একজন লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের পরামর্শ নেয়া হয়েছে। শিগগিরিই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে যশোর শিক্ষা বোর্ড।