কল্যাণ ডেস্ক
ইরান তার সর্বকালের সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে। মঙ্গলবার রাতে তেহরান প্রায় ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। বলা হচ্ছে, এসব ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরায়েলে গত এপ্রিলে ইরান যে হামলা চালিয়েছিল তার তুলনায় মঙ্গলবারের হামলা অনেক বেশি বিস্তৃত। সোশাল মিডিয়া এক্সে প্রকাশিত একাধিক ভিডিওতে তেহরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের মাটিতে আঘাত হানতে দেখা যায়।
এসব ঘটনায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। কারণ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্য এখন বড়সড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মিসাইল থ্রেট প্রকল্পের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেহরানের কাছে বিভিন্ন পাল্লার কয়েক হাজার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল রয়েছে।
উইসকনসিন প্রজেক্ট অন নিউক্লিয়ার আর্মস কন্ট্রোলের ইরান ওয়াচ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেনজি ২০২৩ সালে কংগ্রেসকে ইরানের কাছে ৩ হাজারের বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল থাকার কথা জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন পাল্লার এসব মিসাইলের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি।
সোশাল মিডিয়ায় প্রাপ্ত ভিডিও যাচাই করে সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ইরান সর্বশেষ ইসরায়েলে হামলায় শাহাব-৩ ব্যালিস্টিক মিসাইলের কয়েকটি মডেল ব্যবহার করেছে।
আর্মামেন্ট রিসার্চ সার্ভিসেসের (এআরইএস) গবেষণা সমন্বয়কারী প্যাট্রিক সেনফটের মতে, তরল জ্বালানি ব্যবহার করে নির্মিত ইরানের সব মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের মূল ভিত্তি হল শাহাব-৩। মিসাইল থ্রেট প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের সমরাস্ত্র তালিকায় ২০০৩ সালে যুক্ত হয় শাহাব-৩ মিসাইল। এটি ৭৬০ থেকে ১২০০ কিলোগ্রাম ওজনের ওয়্যারহেড বহন করতে পারে। মোবাইল ও সাইলো উভয় লাঞ্চার থেকেই এটি উৎক্ষেপণ করা যায়।
ইরান ওয়াচ বলছে, শাহাব-৩ মিসাইলের উন্নত সংস্করণ গাদর ও ইমাদ নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তু থেকে প্রায় ৩০০ মিটারের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।
ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সর্বশেষ হামলায় তেহরান ফাত্তাহ-১ নামের নতুন ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এটি শব্দের গতির পাঁচগুণ, অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ৩,৮০০ মাইল বা ৬,১০০ কিলোমিটার গতিতে গিয়ে আঘাত হানতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত ফ্লাইটের সময়, বিশেষ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে হাইপারসনিক গতিতে পৌঁছায়। ‘হাইপারসনিক’ শব্দটি সাধারণত হাইপারসনিক গ্লাইড গাড়ি ও হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইলকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই উচ্চপ্রযুক্তির অস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অত্যন্ত উচ্চগতিতে যেতে ও নিজের গতিপথ পাল্টাতে পারে। ফলে এগুলো আটকানো বেশ মুশকিল।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ফ্যাবিয়ান হিঞ্জের মতে, ফাত্তাহ-১ কোনও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়। তার মতে, ফাত্তাহ-১ মিসাইলটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে অল্প সময়ের জন্য মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পথ পরিবর্তন করতে সক্ষম। তবে এটি ইরানের আগের মিসাইলগুলোর তুলনায় অনেক উন্নত। তবে ইরান মঙ্গলবারের হামলায় ফাত্তাহ-১ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে কি না এনিয়ে সন্দিহান ছিলেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ট্রেভর বল বলেন, “এটি তাদের নতুন ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর মধ্যে একটি। এটি ব্যবহার করে তারা অনেক কিছু হারাতে পারে। ইসরায়েল এই মিসাইল সম্পর্কে জেনে যাওয়ায় আরও বেশি সতর্ক হবে। এতে ইরানের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা
ইসরায়েল ব্যালিস্টিক থেকে শুরু করে ট্র্যাজেক্টোরিজ ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা রাখে। ক্রুজ মিসাইল ও রকেটও তারা ঠেকিয়ে দিতে পারে।
ইসরায়েলের আয়রন ডোমব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক কিছু হামলা পুরোপুরি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতি এ ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ব্যবস্থাটি আগত রকেট ও আর্টিলারি অস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। ইসরায়েলের আয়রন ডোম মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
কিন্তু আয়রন ডোম হলো ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার নিচের স্তর। দেশটির মিসাইল ডিফেন্স অর্গানাইজেশন (আইএমডিও) অনুসারে, মঙ্গলবার রাতে উৎক্ষেপিত ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা কার্যকর নয়।
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পরবর্তী স্তর হলো ডেভিডের স্লিং। আইএমডিওর মতে, এই ব্যবস্থাটি স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার মিসাইল হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।
মিসাইল থ্রেট প্রজেক্ট অনুসারে, ডেভিডের স্লিং ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম ও ইউএস প্রতিরক্ষা কোম্পানি রেথিয়নের যৌথ প্রকল্প। ১৮৬ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে এটি স্টানার ও স্কাইসেপ্টর কাইনেটিক হিট-টু-কিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
ডেভিডের স্লিং ছাড়া অ্যারো ২ ও অ্যারো ৩ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তৈরি করেছে ইসরায়েল। সিএসআইএসের মতে, অ্যারো ২ বিস্ফোরক ব্যবহার করে আগত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে তার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগেই বায়ুমণ্ডলে থাকতে ধ্বংস করে দেয়।
মিসাইল ডিফেন্স অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের মতে, অ্যারো ২ ক্ষেপণাস্ত্রের পরিসর ৫৬ মাইল ও সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩২ মাইল। সংস্থাটি অ্যারো ২ কে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থার চেয়ে উন্নত প্রযুক্তি বলে উল্লেখ করেছে।
অ্যারো ৩ ক্ষেপণাস্ত্র আগত ব্যালিস্টিক মিসাইলকে আকাশেই ধ্বংস করতে হিট-টু-কিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মঙ্গলবার রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ১২টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র মেজর জেনারেল প্যাট রাইডার বলেছেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থানরত নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস কোল ও ইউএসএস বুল্কেলি থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়েছে।
ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে কোন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে- তা জানায়নি পেন্টাগন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ডেস্ট্রয়ার জাহাজগুলো এজিস ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সজ্জিত। এসব মিসাইল আকাশেই আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
জর্ডানের বিমান বাহিনী মঙ্গলবার রাতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে বলে দেশটির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোনও বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি।
