আসছে বিশ্ব ভালোবাসা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
নিজস্ব প্রতিবেদক: সারা দেশে বিধিনিষেধ সরকার আরও দুই সপ্তাহ বাড়িয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন যশোরের গদখালির ফুল চাষিরা। কেননা ফুল বিক্রির বড় দুই দিন হলো ১৪ ফেরুয়ারি ও ২১ ফেরুয়ারি। এই দুই দিবসকে ঘিরে ফুল পরিচর্যা করছেন চাষিরা। করোনার কারণে এসব ফুল বিক্রি করতে না পারলে আর্থিকভাবে পঙ্গু হবে চাষিরা। বৃহস্পতিবার শুধুমাত্র গোলাপের দাম পেয়েছে চাষিরা। এছাড়া অন্য ফুলের দাম মেলেনি।
মহামারি করোনা ও আম্পান ঘূর্ণিঝড়ের কারণে টানা দুই বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে গদখালির ফুলচাষি শফিয়ার রহমান (৪৫) তিন বিঘা জমিতে গোলাপ ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করেছেন । আসছে পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য ফুলগুলো বিক্রি করে গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন তিনি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে হঠাৎ করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন বিস্তারে কারণে সরকার বিধিনিষেদ জারি করেছে। এতে চিন্তার ফেলেছে তাকে। করোনার বিধিনিষেধে ইতোমধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বন্ধ হওয়ায় কমতে শুরু করেছে ফুলের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বিক্রি নিয়ে সংশয়ে এই ফুল চাষি।
হাড়িখালি গ্রামের চাষি রফিকুল হাসান বলেন, করোনা আর আম্পানে লন্ডভন্ড হওয়া ফুল ক্ষেত রক্ষায় ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবাদ শুরু করেছিলেন। আশা করেছিলাম, সামনের দিবসে সঠিক দামে ফুলগুলো বিক্রি করতে পারলে ঋণ শোধ করতে পারবো। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনার সাথে এসেছে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন। ফুলের ভরা মৌসুমে সরকার সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় ফুলের দাম কমে গেছে। কোন কারণে যদি আবার ফুল বেচাকেনায় ভাটা পড়ে তাহলে তার পথে বসা ছাড়া গতি থাকবে না।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি-পানিসারা ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় হাজারো একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে আছে মাঠগুলো। পথের দুই ধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের ক্ষেত। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ বিছানা যেন বিছিয়ে রেখেছে। এ দৃশ্যে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি জুড়িয়ে যায় হৃদয়ও। দেশে উৎপাদিত ফুলের ৬০ ভাগ যোগান হয় এখান থেকে। যেখানে গেলে চোখে পড়বে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ফুল কেটে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই বান্ডিল করে চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। কেউ ফুল কাটছে, কেউ নিড়ানি দিচ্ছে। ফুলের ভরা মৌসুমের এমন কর্মব্যস্ততায় মুখে হাসি থাকার কথা থাকলেও করোনা-ওমিক্রনে দুশ্চিন্তার বিরাজ করছে ফুল চাষিদের।
পানিসারা এলাকার ফুল চাষি শহিদুল হক বলেন, গেল দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বেঁচতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিলাম। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছে। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় সেপ্টেম্বর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলাম ফুলের আবাদ। কিন্তু ৪ মাস ফুল পরিচর্যা করে ফুলের ভরা মৌসুমে এসে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বেচাকেনায় সংশয়ে রয়েছি।
গদখালির টাওয়া গ্রামের কৃষক নিমাজ উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে কোন উৎসব না হওয়ায় ফুল বিক্রি করতে পারিনি। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনা স্বাভাবিক হওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হওযায় ফুল বেচাকেনা ছিলো ভালো। এবারও ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে আসন্ন সময়ে করোনার হানা দিয়েছে। তাই এ বছরও কত টাকার ফুল বিক্রি হবে, তা নিয়ে অবশ্য শঙ্কায় আছেন তিনি। কারণ, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ব্যাপক হারে কমেছে। উৎসব আয়োজনও সীমিত হয়ে পড়েছে। অন্য অনেক ফুলচাষিও অতীতের মতো ফুল বিক্রি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।
গদখালি বাজারে কৃষক ও স্থানীয় পাইকার ব্যবসায়ী আজমল হোসেন বলেন, বর্তমানে ফুলের বাজার খারাপ। লকডাউন না দিলেও করোনা আতংকে ফুল বেচাকেনা কম। বর্তমানে বাজারে প্রতি হাজার গাদা ফুল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিলো ৮০০-৯০০ টাকা দরে। একেকটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৭-৮ টাকায়। রজনীগন্ধা একেকটি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায়, যা আগে ছিল ৭-১০ টাকায়। রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪-৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৯-১২ টাকায়। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ৪- ৬টাকায়, যা আগে দাম ছিল ৮-১০ টাকায়। ফুল বাঁধার জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা আঁটি, যা আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ২০-৩০ টাকা। যা আগে বিক্রি হতো ৩০-৪৫ টাকায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ফুলের ব্যবসাটি মূলত অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক। গত দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বিক্রি করতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিল চাষীরা। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছিলেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করে ফুলের আবাদ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন চিন্তার ভাজ ফেলেছে তাদের কপালে। সামনের দুই দিবসে ফুল বিক্রি করতে না পারলে আামদের নিস্ব হতে হবে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুবাষ বসু বলেন, চলতি বছর ঝিকরগাছার গদখালি-পানিসারা এলাকায় সাড়ে ৬০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হয়েছে। করোনাকাল কাটিয়ে উঠে এখানকার কৃষকরা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এবার ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো ছিলো। কিন্তু আসছে দুই দিবসে বিধি নিষেধ থাকলে ফুল চাষিদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।