সক্রিয় হচ্ছেন চাকলাদারের কর্মীরাও, বদলে যাচ্ছে হিসাব
নিজ আসনে নির্ভার হতে পারছেন না শাহীন চাকলাদারও
নিজস্ব প্রতিবেদক
‘এমপি সাহেবকে গত দশ বছরে সামনাসামনি দেখি নাই। তবে ওনার লোকদের দেখেছি মাঝে মাঝে। এবার ওনার বিপক্ষে স্বতন্ত্র যিনি দাঁড়িয়েছেন সে ভালো প্রচারণা করছে। তবে যারা প্রতীকের রাজনীতি করে তারা নৌকায় ভোট দিবে,’ এভাবেই দ্বাদশ নির্বাচনে ভোট নিয়ে নিজের কথা জানালেন যশোর শহরতলীর শেখহাটি গ্রামের এক চা বিক্রেতা। এই চা বিক্রেতার কথার সাথে মিল পাওয়া গেল যখন গত শুক্রবার দুপুরে শহরের কাজীপাড়াস্থ যশোর সদরের বর্তমান সংসদের বাড়িতে যাওয়া হয়। তখন জানানো হয় তিনি ঢাকাতে।
যশোর-৩ (সদর) আসনে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি ক্লিন-ইমেজখ্যাত। তবে সম্প্রতি তার বলয়ে ভিড়েছেন বিতর্কিত ও সন্ত্রাসীরা। ফলে তার সেই ইমেজেও ভাটা পড়েছে। এবারে তার জন্য শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঈগল প্রতীকে নির্বাচন করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ। এই দুই জনকে নিয়ে ভাগ হয়ে গেছে যশোরের স্থানীয় রাজনীতি ও নির্বাচন। আর এই আসনে না থেকেও আছেন যশোর-৬ আসনের (কেশবপুর) নৌকার প্রার্থী শাহীন চাকলাদার।
শাহীন চাকলাদারের আসন ভিন্ন। তবে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় সূত্র বলছে, জেলা আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ কাজ করছে মোহিত কুমার নাথের পক্ষে। আবার চাকলাদারের আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এইচএম আমির হোসেন। তিনিও শাহীনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার সেখানেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন স্বতন্ত্রের পক্ষে। চাকলাদারের নিজ এলাকা জেলা সদর হওয়াতে কেশবপুরের স্থানীয় নেতারা চান স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে।
নির্বাচনের আগে ভাগ হয়েছেন নেতারা :
দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যশোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শাহীন-নাবিল বিরোধ এক দশকের। মূলত সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন ঘিরেই তাদের দুজনের এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দুইজনই সদরের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে সদর থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেননি শাহীন। এই আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন টানা দুই বারের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। আর শাহীন চাকলাদার পেয়েছেন কেশবপুর আসন থেকে। তবে সদরের ভোটযুদ্ধে শাহীনের দৃশ্যমান লড়াই না থাকলেও আলোচনায় রয়েছে তার নাম। মোহিত কুমার নাথের প্রতি ভেতরে-ভেতরে শাহীনের সমর্থন থাকার গুঞ্জনও উঠেছে। এমনকি শাহীনের সঙ্গে শহর ও সদরে যারা রাজনীতি করেছেন তারা নাবিলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মোহিতের ভোটের প্রচারণাতে অংশ নিচ্ছেন। নেতা কর্মীদের ভাষ্য, এই আসনে চাকলাদার না থাকলেও তার ছায়া রয়েছে।
নাবিলের অনুসারী ও সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল বলেন, শাহীন চাকলাদারের ইন্ধনে মোহিত নাথ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাই প্রচারণাতেও চাকলাদারের লোকজন মোহিতের প্রচারণাতে অংশ নিচ্ছেন। আবার সদরের আঁকড়ে থাকা বড় বড় পদধারী নেতারাও সদর ছেড়ে কেশবপুরে প্রচারণা করছেন। তবে এই বিষয়ে শাহীন চাকলাদার বলেন, মোহিত কুমার নাথ তার সঙ্গে রাজনীতি করলেও তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কোন পরামর্শ তিনি দেননি। মোহিত স্বতন্ত্র হয়েছেন তার ব্যক্তিগত বিষয়। যারা দলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা তার ও দলেরও কেউ না।
জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদরে আবারও ক্ষমতায় আসতে প্রচারণা জোরদার করেছেন কাজী নাবিল আহমেদ। আসনটিতে প্রচারণায় জেলা ও সদরের একাংশের নেতাকর্মীরা নাবিলের সঙ্গে দেখা গেছে। আর এক অংশ নেতাকর্মীদের মোহিতের প্রচারণাতে দেখা গেছে। গত রবিবার জেলা শ্রমিক লীগের একটি অংশ মোহিতের কার্যালয়ে গিয়ে তার প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি সদরের শীর্ষ নেতাকর্মীরা সদর ছেড়ে শাহীনের আসন কেশবপুরে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, যশোর সদর ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক এস এম মাহমুদ হাসান বিপু, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোৎসা আরা মিলি, আওয়ামী লীগ নেতা মশিয়ার রহমান সাগরসহ সদর উপজেলার শীর্ষ নেতাকর্মীরা সদর ছেড়ে কেশবপুরে শাহীন চাকলাদারের প্রচারণাতে ব্যস্ত। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ বলেন, নেত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোন ধরণের বারণ করেননি। বরং কেন্দ্রে ভোটার আনাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে দাড় করিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে আছে। যখন মোহিত কুমার নাথের মন্তব্য জানতে তার অফিসে যাওয়া হয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন যশোর সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। তিনি কাজ করছেন মোহিত কুমার নাথের পক্ষে। তিনি বলেন, ‘তিনি মোহিত কুমার নাথের সমর্থক। নেত্রীর নির্দেশও আছে। তাই এখানে কাজ করতে কোন বাধা নেই। মোহিত কুমার নাথ বলেন, কাজী নাবিল দুইবার সংসদ সদস্য হয়েও যে পরিমাণে উন্নয়ন হওয়ার কথা সেটা হয়নি। সেই কারণে তাকে জনগণ চায় না। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি প্রার্থী হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহীনের অনুসারী হিসাবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। যশোর সদরে মনোনয়ন পাওয়া নিয়েই দুজনের দ্বন্দ্ব। সদরে শাহীনের প্রভাব আছে। শাহীনের অস্তিত্বের স্বার্থে আর দল স্বতন্ত্রের তকমার সুযোগে নাবিলের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন মোহিত। জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, সদরের একটি পক্ষ নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে তারা জনগণকে সাথে নিয়ে সকল ষড়যন্ত্রেও জবাব দিবেন।
কি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু :
দলীয় সূত্রে বলছে, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিলের সঙ্গে দ্বদ্ব শুরু হয় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নকে ঘিরে। সদর আসনে দুজনেই দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পেয়েছিলেন নাবিল। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন শাহীনের সমর্থকরা। এর পর আবারও ২০১৮ সালেও মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন শাহীন। দল মনোনয়ন দেন নাবিলকে। এতে শাহীন-নাবিলের দ্বন্দ্ব বাড়ে প্রকট। এরপর ২০২০ সালে কেশবপুরের সংসদ ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে আসনটি শুন্য হলে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হন শাহীন চাকলাদার।
বিভক্ত কেশবপুর আ.লীগ :
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে হাতুড়ি বাহিনীর কাছে কেশবপুর উপজেলা জিম্মি হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যদের হাতে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের বেপরোয়া আচরণের হাত থেকে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি। তবে যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের শাহীন চাকলাদার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় কেশবপুরের চিত্র পাল্টে যায়। হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যায়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে আওয়ামী লীগে হাতুড়ি বাহিনী না থাকলেও শাহীন চাকলাদারের অনুসারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। স্বজনপ্রীতি, বিভিন্ন স্থানে নিয়োগের নামে বিএনপি নেতাকর্মীদের পুর্নবাসন, অনিয়ম ও দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার বর্তমানে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এক সময়ের ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ এখন গ্রুপ; উপ গ্রুপে বিভক্ত। তার সঙ্গে ভোটের প্রচারণাতে নেই উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফাসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষপদধারী নেতাকর্মীরা। এসব নেতাকর্মীরা শাহীনকে হটাতে নির্বাচনী মাঠে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমির হোসেনের পক্ষে।
নেতাকর্মীদের ভাষ্য, ‘টানা দেড় দশক কেশবপুরবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পায়নি। ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না পাওয়াতে উপজেলাতে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি দাদের। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কেশবপুরের মানুষ নির্যাতিত ছিলো। সবার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যশোর থেকে শাহীন চাকলাদারকে এনে আমরা নির্বাচিত করি। কিছুদিন কেশবপুরের মানুষ ভালো থাকলেও আবারও পূর্বের চেহেরায় ফিরেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শাহীনের অনুসারীদের কাছে নির্যাতিত। তাই তারা পরিবর্তন চান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চান। স্বতন্ত্র প্রার্থী এইচ এম আমির হোসেন বলেন, সরকার যে উন্নয়ন, সেটা কেশবপুর বাসী বঞ্চিত হয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না পাওয়াতে। প্রতিবার অন্যজায়গার বাসিন্দাকে প্রার্থী হয়ে; পরবর্তীতে জনপ্রতিনিধি হয়ে তারা কেশবপুরে সময় দিতে পারে না। তাই জনগণের দাবিতে আমি প্রার্থী হয়েছি। এই বিষয়ে শাহীন চাকলাদার বলেন, আমি নির্বাচিত হয়ে পরিমাণ উন্নয়ন করেছি; সেই উন্নয়নের কারণেই আবারও তারা নৌকায় ভোট দিবে।