কল্যাণ ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে আটকের পর পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের হত্যার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
কয়েকটি মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায় বুধবার রাত ৮টার দিকে আটকের পর তোফাজ্জলকে প্রথমে গেস্ট রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করা হয়। পরে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর চলে।
এরপর প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যসহ হলের হাউস টিউটররা তোফাজ্জলকে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেলে পুলিশ আগে তাকে হাসপাতালে নিতে বলে। অচেতন তোফাজ্জলকে রাত ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় কয়েকজন শিক্ষার্থী। রাত পৌন ১টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলে ওই শিক্ষার্থীরা লাশ রেখে চলে যায়।
নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নে। বিভিন্নজন জানিয়েছেন, অল্প সময়ের ব্যবধানে মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাইকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন তোফাজ্জল। ঘুরে বেড়াতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
তবে স্থানীয় সূত্রের দাবিতে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসুদ কামাল ওরফে তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
রাতে কী হয়েছিল হলে
ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যায় হলে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। রাত ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে প্রবেশ করে। তখন শিক্ষার্থীরা দুপুরে ৬টি মোবাইল চুরির ঘটনার চোর সন্দেহে তাকে আটক করে মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে গিয়ে জেরা ও মারধর করতে থাকে।
এক পর্যায়ে, তাকে নিয়ে হল ক্যান্টিনে খাওয়ানো হয়, যে ঘটনার ভিডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, তোফাজ্জল হাত ধুয়ে খেতে শুরু করেন। ভাত মুখে দেওয়ার পর একজন জিজ্ঞেস করেন, “বড় ভাই খাবার কেমন?” উত্তরে তিনি বলেন, “আল্লাহর রহমতে ভালো”। একজনকে বলতে শোনা যায়, “তুই খাওয়া অবস্থায় যদি না থাকতি, আবারও মার খাইতি মিথ্যা বলার জন্য”। এ সময় আশপাশে থাকা শিক্ষার্থীদের উচ্চস্বরে হেসে উঠতে শোনা যায়। একজন হাসতে হাসতে কটাক্ষ করে বলে ওঠেন, “খাবারের মান না কি ভালো?”
খাওয়ানোর ঘটনার পর এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বুক, পিঠ, হাত ও পায়ে ব্যাপক মারধর করেন একদল শিক্ষার্থী।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের দাবি, তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি মারধর করেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, যিনি হল শাখা ছাত্রলীগের সদ্য পদত্যাগ করা উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক। তার সঙ্গে আরও ছিলেন, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনিস্টিউটের মোত্তাকিন সাকিন। নির্যাতক এই শিক্ষার্থীদের সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “দুই-তিনজন মিলেই ওরে (তোফাজ্জল) ওখানে মেরে ফেলছে। এরা হলেন- মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল, ফিরোজ ও জালাল। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। গেস্ট রুমে চোরের হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাকে, মারতে মারতে ও (তোফাজ্জল) পড়ে গেছে। এরপর পানি এনে তাকে পানি খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এ সময় সবাই হাততালি দেয়।
“সবাই খুশি হয় কারণ তাকে আবার মারতে পারবে। এরপর আবার শুরু হয় পেটানো। এই দফায়ও সবচেয়ে বেশি মেরেছে ফিরোজ। পরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের জালাল আসে। জালাল এসে আরও মারতে উৎসাহ দেয়; বলে- ‘মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একবারে’। এ সময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। পরে সুমন এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়।”
কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, মারধরের এক পর্যায়ে দুই-তিনটা ফোন নম্বর দেয় তোফাজ্জল। সেই নম্বরে ফোন দিলে অপর পাশ থেকে জানানো হয়, তোফাজ্জল মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। কিন্তু নির্যাতক শিক্ষার্থীদের দল তা বিশ্বাস করেনি। সদ্য পদত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহমেদ লাঠি দিয়ে তোফাজ্জলের গোপণাঙ্গে আঘাত করেন। সে সময় তাকে হলের সিনিয়ররা থামাতে এলেও সে পাগলের মতো করে তোফাজ্জলকে আঘাত করতে থাকেন। পরে শিক্ষকরা আসার পরও তাকে থামাতে ব্যর্থ হন।
পরবর্তীতে হল কর্তৃপক্ষ তোফাজ্জলকে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে হস্তান্তর করার পর তারা তাকে হাসপাতালে না নিয়ে প্রথমে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান বলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
এরপর পুলিশের পরামর্শে অচেতন তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে চিকিৎসক দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
চ্যানেল ২৪ টিভির এক সাক্ষাৎকারে তোফাজ্জলের মামাতো বোন বলেন, “ওদের বারবার আমরা বলছিলাম ও (তোফাজ্জল) মানসিকভাবে সুস্থ না। কিন্তু ওরা তা মানতে রাজি হচ্ছিল না। এক সময় তারা ৩৫ হাজার টাকা দাবি করে।”
তদন্ত কমিটি
পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হল প্রশাসন। সাত সদস্যের কমিটিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে ফজুলল হক হলের আবাসিক শিক্ষক আলমগীর কবিরকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করেন হল প্রাধ্যক্ষ শাহ্ মো. মাসুম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ শফিউল আলম খান, শেখ জহির রায়হান, মো. মাহাবুব আলম, আছিব আহমেদ, সহকারী আবাসিক শিক্ষক এম এম তৌহিদুল ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর (বিজ্ঞান অনুষদ) এ কে এম নূর আলম সিদ্দিকী।
প্রাধ্যক্ষের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফজলুল হক মুসলিম হলে গতকাল (বুধবার) রাতে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তদন্ত করার জন্য এই কমিটি গঠন করা হলো। গতকাল রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলে সংগঠিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শীদের আজ দুপুর ১২টার সময় হল কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বিচার দাবি
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফজলুল হক হলের বেশ কিছু শিক্ষার্থী হল ছেড়ে গেছেন। সকালে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা হলের প্রাধ্যক্ষ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বলেন, “আমরা বিশ্বাস করতে চাই এটি ছাত্র-জনতার প্রশাসন। কিন্তু সে যদি তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরাও জানি আমাদের কী করতে হবে। আর যে শিক্ষার্থীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার অধিকার আছে কি না—এই প্রশ্ন আমি শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে যেতে চাই।”
তারপর শিক্ষার্থীরা প্রক্টর অফিসে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “আজ সন্ধ্যার মধ্যেই তদন্ত কমিটি প্রাথমিক রিপোর্ট দেবে।”
এ ঘটনায় হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এজহার দায়ের করেন। পরে এজহারটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ দুপুরে নিজ অফিস কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। প্রক্টর বলেন, এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এখানে হল প্রশাসনের অবহেলা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, হলের প্রভোস্ট রাতে ঘটনাস্থলেই যাননি, হাউজ টিউটররা ছিলেন। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
ছাত্রলীগ নেতাসহ দুই শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে দুই শিক্ষার্থীকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
আটক হওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন- ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ (২০১৮-১৯ সেশন) এবং মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সুমন (২০২১-২২)। জালাল আহমেদ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।
ফজলুল হক হলের এক শিক্ষার্থীর দাবি, “জালাল ছাত্রলীগ করত। ক্যাডার, মারামারি সব ঘটনায় যুক্ত ছিল। আন্দোলনের সময় বিপদে পড়বে ভেবে ওইসময় পদত্যাগ করেছিল। এ কারণেই ও হলে থাকতে পারছিল।”