ঢাকা অফিস
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবার পর্যন্ত টানা ১৩ দিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার অসুস্থতার প্রভাব পড়েছে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিশেষ করে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্পষ্ট ভাটা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর হিসাব-নিকাশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শুধু বিএনপিই নয়-নির্বাচনমুখী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির গতি-ধারাও অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। জনসাধারণের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ আগের মতো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
নির্বাচন-প্রস্তুতির মধ্যেই অসুস্থ খালেদা জিয়া :
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর গত দেড় বছরে সংস্কার, বিচারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সরকার ঘোষণা দেয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে আগামী ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ৮, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারিকে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
ঠিক এমন সময়েই হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন দেশের রাজনীতিতে আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া। এতে বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বিএনপির কর্মসূচিতে ভাটা, প্রার্থীদের প্রচারণা স্থবির :
যদিও বিএনপি ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কয়েকটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তবে মাঠপর্যায়ে তেমন জোরালো প্রচারণা শুরু করা যাচ্ছে না। প্রার্থীরা বলছেন, দলের প্রধান যখন গুরুতর অসুস্থ, তখন জোরালো নির্বাচনী প্রচারণায় নামা শোভন নয়।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি। সারা দেশ ও বিশ্বের মানুষ তার জন্য দোয়া করছে। নেত্রী সুস্থ হলে রাজনীতির বাকি হিসাব-নিকাশ আবারও সামনে আসবে।”
মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরাও আপাতত মাঠের রাজনীতি থেকে দূরে থাকছেন। যশোর-২ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী মিজানুর রহমান খান বলেন, “আমার নেত্রীর সুস্থতাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয়। আমি এলাকাজুড়ে তার জন্য দোয়ার আয়োজন করছি। নির্বাচন নিয়ে পরে ভাববো।”
অন্যান্য দলগুলোর কর্মসূচিতেও শ্লথতা :
জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দল পাঁচ দফা দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশ করলেও জনসমাগম তেমন হচ্ছে না। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপির মাঠে জোরালো উপস্থিতি না থাকায় নির্বাচনি প্রতিযোগিতাও অনেক জায়গায় ম্লান হয়ে পড়েছে।
পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী মাসুদ সাঈদী বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অনন্য প্রতীক। তার অসুস্থতা দেশের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে বড় প্রভাব ফেলছে।”
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “তার অসুস্থতা শুধু বিএনপি নয়, পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনেই প্রভাব ফেলেছে।”
এভারকেয়ারের সামনে মানুষের ঢল :
গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে মানুষের ভিড় জমতে থাকে। কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এই ভিড় শুধুই ভালোবাসা আর দোয়ার।
রিকশাচালক রিপন মিয়া বলেন,“ম্যাডাম যদি একবার জানালায় আইসা হাত নড়াইতো, শান্তি পাইতাম। আল্লাহ যেন তারে সুস্থ কইরা দেয়।”
এভারকেয়ারের গেটে দেখা গেছে-রিকশাচালক থেকে শুরু করে শিক্ষক, ছাত্র, কর্পোরেট কর্মকর্তা-সব শ্রেণির মানুষ তার সুস্থতার জন্য দোয়া করছেন।
চিকিৎসা ব্যবস্থা ও লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি :
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত হয়েছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড। তার লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার চিকিৎসা চলছে।
বৃহস্পতিবার মেডিকেল বোর্ড তার উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে দেশে এসেছেন তার পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৪ দলের একটি প্রতিনিধি দলও তার সঙ্গে যাবে।
প্রথমে কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসার কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে এখন জার্মানির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী রোববার তাকে লন্ডনে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ভিভিআইপি ঘোষণা, এসএসএফের নিরাপত্তা :
খালেদা জিয়াকে ‘রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি)’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-কে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কাউকে এভাবে এসএসএফ সুরক্ষা দেওয়ার নজির বিরল।
রাজনৈতিক চরিত্র থেকে জনতার আবেগ :
বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া এখন আর শুধু বিএনপির নেত্রী নন—তিনি রূপ নিয়েছেন জনতার আবেগে। তার দীর্ঘ কারাবাস, শারীরিক নির্যাতন, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং নীরব সহনশীলতা তাকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন,“খালেদা জিয়া এখন শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তার অসুস্থতায় পুরো দেশ ব্যথিত।”
