খুলনা প্রতিনিধি
গত জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর খুলনায় বেড়ে উঠেছে হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মাসে খুলনাতে মোট ৪৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে। শুধুমাত্র এই বছরের নভেম্বরে শহরে সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা সাধারণ মানুষকে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কে ফেলেছে।
খুলনার বিভিন্ন জনবহুল এলাকা, বিশেষ করে আদালত চত্বরে দিনদুপুরে হত্যার ঘটনা ঘটছে, যা পুরো নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি নির্দেশ করে। ১৬ নভেম্বর দুপুরে নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারের কালভার্ট এলাকায় একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে, যেখানে বাড়ির মধ্যে নানি মহিতুন্নেসা (৫৫), তার নাতি মুস্তাকিম (৮) ও নাতনি ফাতিহাকে (৬) গুলিবিদ্ধ ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই রাতে করিমনগরের নিজ বাড়িতে আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক যুবককে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ২৭ নভেম্বর রাতে খালিশপুর ফেয়ার ক্লিনিকের সামনে ছুরিকাঘাতে ইমান নামে আরেক যুবকের মৃত্যু ঘটে। সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর আদালত চত্বরে দুই জনের খুনের ঘটনা ঘটেছে, যা জনমনে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
খুনের এই ধারাবাহিকতায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে খুলনার নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো। খুলনা মহানগর বিএনপি প্রতিটি ওয়ার্ডে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে এই সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিরুদ্ধে গত শনিবার নগরীতে মানববন্ধন করেছে ‘আইন অধিকার বাস্তবায়ন ফোরাম’। গত রবিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
খুলনা শহর দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাস ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর সমস্যা মোকাবিলা করে আসছে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে খুলনা ছিল চরমপন্থীদের অভয়ারণ্য। বোমা হামলা, গুলি করে হত্যা, অপহরণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল সাধারণ ঘটনা। সাংবাদিকসহ বহু নিরীহ মানুষ এই সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন। তবে ২০০০ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব গঠন ও যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ ও ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’ পরিচালনা করে। এই অভিযানগুলোতে অধিকাংশ চরমপন্থী সন্ত্রাসী ধ্বংস করা হয় বা গ্রেপ্তার হয়, ফলে খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও পুলিশের বক্তব্য
যদিও অতীতের ঐ তীব্র সন্ত্রাসী তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবে সম্প্রতি আবারও খুলনায় বর্ধিত সন্ত্রাস ও সহিংসতার ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বিশেষ অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন নাগরিক নেতা ও সংগঠন।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার জানিয়েছেন, “আমরা হত্যাকাণ্ডের প্রায় সব কারণ উদ্ঘাটন করেছি এবং জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় এনেছি। আদালত চত্বরে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
সরাসরি মানুষের কণ্ঠে:
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “এভাবে খুন-খারাপি চলতে থাকলে কীভাবে আমরা নিরাপদ বোধ করব? বাইরে বের হওয়াও ভয়ের ব্যাপার হয়ে গেছে।” অপর এক শিক্ষার্থী জানান, “আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করছি, এমন অবস্থা চলতে থাকলে খুলনা বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে।”
খুলনার এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত ও কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন জরুরি, নইলে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ভয়াবহতা বাড়তেই থাকবে।
