তদন্তে ডিবি, পিবিআই ও থানা পুলিশের পৃথক টিম
নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরে নিজ বাড়ির সামনে চিহ্নিত সন্ত্রাসী মীর সাদী (৩৩) কে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। সোমবার (১৭ মার্চ) রাত সাড়ে এগারোটায় শহরের মুজিব সড়কের পঙ্গু হাসপাতালের পেছনে নিজ বাড়ির সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। নিহত সাদী রেলগেট এলাকার মীর শওকতের ছেলে।
সাদীর স্বজন ও সিসি টিভির ফুটেজ দেখে জানা যায়, শহরের টিবি ক্লিনিক এলাকার বাবুর ছেলে চিহ্নিত সন্ত্রাসী একাধিক মামলার আসামি ট্যাটু সুমন, আশ্রম রোডের আলীর ছেলে মেহেদী সাদীকে নিজবাড়ির সামনে তাকে ৬ থেকে ৭ রাউন্ড গুলি করে পালিয়ে যায়। সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায় রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে মূল সড়ক থেকে মোটর সাইকেলে সাদী বাড়ি গলিতে প্রবেশ করে। এসময় সাদীকে বহণকরা মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন সাদীর চাচাতো ভাই রাকিব। এর পরপরই মোটরসাইকেলের পেছনে দৌড়ে গলিতে প্রবেশ করে দুই সন্ত্রাসী ট্যাটু সুমন ও মেহেদী। সাদী বাসার সামনে পৌঁছালেই গুলি করে দুই সন্ত্রাসী পালিয়ে যায়। এ সময় সাদীর চাচাতো ভাই রাকিব সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করার ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
এসময় গুরুত্ব আহত সাদীকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে দেওয়া হলে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে নেওয়া হলে পথে সাদীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোতোয়ালি কোন অভিযোগ বা মামলা দায়ের হয়নি।
আছরবাদ যশোর রেলগেট কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে খড়কি কবরস্থানে সাদীকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। প্রাথমিক তথ্য ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে তদন্তে নেমেছে ডিবি, পিবিআই ও থানা পুলিশের পৃথক টিম। এই তিনটি দায়িত্বশীল সংস্থা থেকে বলা হয়েছে ওই এলাকার পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে, ঘটনার পর যশোর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর ই আলম সিদ্দিকী জানান, কারা কি কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটা পুলিশ তদন্ত করছে। নিহত সাদী সন্ত্রাসী ও যাদের নাম আসছে তারাও সন্ত্রাসী। সকলের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযানে শুরু করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যশোর কোতোয়ালি থানায় কোন মামলা হয়নি। কোতোয়ালি থানার ওসি কাজী বাবুল হোসেন জানিয়েছেন, নিহতের স্বজনরা কেউ এখনো এজাহার দেয়নি। এজন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
হত্যাকান্ডের যে কারণগুলো সামনে আসছে :
সাদী খুন হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে রেল বাজারের ইজারার অর্থ ভাগাভাগি ও মুজিব সড়কের অভিজাত মার্কেটগুলো থেকে চাঁদার টাকা এবং রেলগেট এলাকায় মাদকবিক্রির ভাগবাটেয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাদী যশোরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ত্রাস যুবলীগ নেতা মেহবুব রহমান ম্যানসেলের প্রধান সহযোগী ছিল। ম্যানসেলের সব কিছু দেখা শোনা করত সাদী। ছায়ার মত ম্যানসেলের সাথে থাকতো সর্বক্ষণিক। সাদীকে যারা হত্যা করেছে তারাও ম্যানসেলের সহযোগী। বছর খানের আগে ম্যানসেলের সাথে নানা বিষয়ে মতবিরোধ হয় সাদীর। তারপর থেকে সাদী আলাদা গ্রুপ করে চলাফেরা করতো। বিষয়টি সেই থেকেই ম্যানসেল ভালো চোখে নেয়নি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পর ম্যানসেল আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে রেলস্টেশন বাজার ও রেলগেট এলাকাসহ মুজিব সড়কের মার্কেটগুলোর চাঁদার টাকা ম্যানসেলকে দেওয়া বন্ধ করে দেয় সাদী। চাঁদার টাকা না পেয়ে ম্যানসেল তার আরেক সহযোগীদের দিয়ে সাদীকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
ছাত্রদল নেতা পলাশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাদী :
২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর যশোর শহরের ঈদগাহ মোড়ে হত্যার শিকার হন তৎকালীন জেলা ছাত্রদলের সহ সভাপতি কবির হোসেন পলাশ। পলাশকে গুলি ও বোমা হামলা করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন সাদী। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মোটরসাইকেলে পালানোর সময় শহরের পালবাড়ি ভাস্কর্য মোড়ে দুর্ঘটনার শিকার হন সাদী। ওই দুর্ঘটনার পর চিকিৎসায় তার এক পা কেটে ফেলতে হয়। সে সময় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ও টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে পলাশ হত্যা মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করে। এক পা হারিয়েও আওয়ামী লীগের সদর আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার প্রভাবে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে আসছিলেন সাদী।
হত্যাকারী ট্যাটু সুমন ম্যানসেল বাহিনীর সদস্য ছিল :
নিহত সাদী ও হামলাকারী ট্যাটু সুমন যশোরের বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহবুব রহমান ম্যানসেল বাহিনীর সদস্য ছিল। ২০২৩ সালের ৫ মার্চ দুপুরে যশোর শহরের সরকারি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে শীর্ষ সন্ত্রাসী ম্যানসেলের নেতৃত্বে হামলা ও মারপিটের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসী ম্যানসেল ও তার তিন সহযোগীকে আটক করে। আটক তিন সহযোগীর মধ্যে মীর সাদী ও মেহেদীও ছিল। আর পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ট্যাটু সুমন। ওই ঘটনার পর যশোর শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ থেকে ম্যানসেলকে বহিষ্কার করা হয়।
অস্ত্রসহ আটক হয় ট্যাটু সুমন :
এর আগে ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর যশোর কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুমন ওরফে ট্যাটু সুমনকে আগ্নেয়াস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার করেছিল। ট্যাটু সুমন শহরের টিবি ক্লিনিক এলাকার কানা বাবু ওরফে আফজালের ছেলে। সুমনের বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৪টি মামলা রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী ম্যানসেলসহ তার বাহিনীর সদস্যরা গা-ঢাকা দেয়। সম্প্রতি তাদের কেউ কেউ আবার এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সাদী খুন হলো বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।