যশোর রেজিস্ট্রি অফিস
আবাধে চলছে দুর্নীতি-৩
‘সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, গোয়েন্দা সংস্থা… সব কেনা। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীও কিছু করতে পারেন নি। শুধুমাত্র মণিরামপুর থেকে বাঘারপাড়ায় বদলি করিয়েছে।’
নিজস্ব প্রতিবেদক: ভলিউম বইয়ের পাতা ছিঁড়ে বিক্রি। বদলির তদবির ও নিয়োগ বাণিজ্য করে জিরো থেকে হিরো বনে গেছে মিলন-সাইফুল চক্র। গড়েছে সম্পদের পাহাড়। যশোর জেলা রেজিস্ট্রি অফিস ছাড়াও উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও চক্রটির জাল বিছানো।
যশোর রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুমটি দক্ষিণ বঙ্গের প্রাচীন মহাফেজ-খানা। ১৯ জেলার দলিল-নথিপত্র এখানে সংরক্ষিত আছে। আর এই রেকর্ড রুম তছনছ করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে দলিলের পাতা ছেঁড়া চক্রটি। জমির মূল দলিল ও তফশিলসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি ছিড়ে বাইরে পাচার করে এখনও দু’হাতে টাকা কামাচ্ছে তারা। সম্পদে ফুলেফেঁপে কোটিপতি বনে গেছে।
এই চক্রের মাধ্যমে যশোরের জেলা ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো থেকেও মাসে কোটি টাকা ঘুষ আদায় হয়। সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে। জেলা রেজিস্ট্রারের কাছের লোক হওয়ায় অন্য সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোয়ও তাদের প্রভাব কম নয়। যশোর রেজিস্ট্রি অফিসের মোহরার শামছুজ্জামান মিলন (বর্তমানে বাঘারপাড়ায় বদলি)। তার সহযোগী একস্ট্রা মোহরার (নকলনবিশ) সাইফুল ইসলামের প্রভাব এতটাই যে ভলিউম বইয়ের পাতা ছেঁড়ার অপরাধ প্রমাণের পরও তাদের চাকরি যায়নি। সাময়িক অব্যাহতির পর স্¦পদে ফিরেছেন। এরমধ্যে একজনের চাকরি স্থায়ীকরণ অর্থাৎ সরকারি হয়েছে। একসময়ের একস্ট্র মোহরার (নকলনবিশ) থেকে মোহরার হয়েছেন শামছুজ্জামান মিলন।
শামছুজ্জামানের মিলনের উত্থানের সত্যি গল্প
২০০০ সাল। তখন থেকে তার যশোর রেজিস্ট্রি অফিসে আসা-যাওয়া শুরু হয়। সে সময় দিনের পর দিন এক শার্ট এক প্যান্ট পরে অফিসে আসতো নকলনবিস শামছুজ্জামান মিলন। যশোর সদরের দেয়াড়া ইউনিয়নের হালসা গ্রামের আজিবর বিশ^াসের তখন অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। কিন্তু পরিবারটি এখন অগাধ বিত্তবৈভবে ভরা। সম্পদের প্রাচুর্য আশপাশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ঘুরতে শুরু করে মিলনের ভাগ্যের চাকা। তখন থেকে শুরু হয় তার রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুম থেকে মূল দলিল ছিড়ে বেচাকেনা। তফশিল খুলে অন্য কাগজ সেখানে রেখে দেয়া। পাশাপাশি সেসময় অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত নকলনবিশ থেকে মোহরার পদেও নিয়োগ পায় মিলন। আর তখন থেকে এসব অনৈতিক কাজ করে বিপুল অর্থ আয় করে কোটি বনে গেছে। তিনি দম্ভোক্তি করে বলে থাকেন আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, গোয়েন্দা সংস্থা সব আমার কেনা। দেখলেন না পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীও আমাকে কিছু করতে পারেন নি। শুধুমাত্র মণিরামপুর থেকে বাঘারপাড়ায় বদলি করিয়েছে।
হালসায় কেউ জমি বিক্রি করলে তার কাছে শোনে : ওই এলাকায় কেউ জমি বিক্রি করতে চাইলে আগে ছোটেন শামছুজ্জামান মিলনের কাছে। জমি বিক্রি করতে হলে আগে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয়। নামে বেনামে বহু জমি কিনে বিস্তর ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছেন। প্রতিনিয়ত একের পর এক জমি কিনে চলেছেন দুর্নীতি ও দলিল-তফশিলের পাতা ছিড়ে বিক্রির টাকায়।
মাটির বাড়ি এখন দ্বিতল : মাটির ঘরে বসবাস করতো শামছুজ্জামান মিলনের পরিবার। দারিদ্রতায় ভরা ছিলো পরিবারটির দিনযাপন। কিন্তু সেই মাটির ঘর আর নেই। সেখানে উঠেছে আলিশান দ্বিতল ভবন। বিলাসি ও আয়েশি জীবনযাপনের সব রকম সরঞ্জামের ব্যবস্থা আছে বাড়িটিতে।
দামি মোটরসাইকেলে চড়েন : একটা সময় ছিলো যখন হালসা থেকে বাসে করে যশোর শহরে রেজিস্ট্রি অফিসে আসতো মিলন। কিন্তু এখন চলাফেরা করে বনেদি কায়দায়। আগস্ট মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটর সাইকেল কিনেছেন। সেটিতে করে এখন চলে তার চলাফেরা।
কোটি টাকার মেহগনি বাগান : বিস্তর ভূসম্পত্তির পাশাপাশি মোহরার মিলনের আছে কোটি টাকার বাগান। এলাকায় জমি কিনে মেহগনি গাছ লাগিয়ে বাগান করেছেন। বর্তমানে ওই জমি ও গাছের দাম কোটি টাকার ওপর।
জেলা রেজিস্ট্রারের ছায়াসঙ্গীসাইফুল ইসলাম
এত গেল পাতা ছেড়া চক্রের হোতাদের একজন শামছুজ্জামান মিলনের কথা। তার অপর সহযোগী সাইফুল ইসলামও সম্পদের দৌড়ে পিছিয়ে নেই। বর্তমান জেলা রেজিস্ট্রারের সাথে তার ব্যপক সখ্যতা। দু’জনের অন্তরঙ্গতা এমনই যেন জেলা রেজিস্ট্রারের সার্বক্ষণিক ছায়া সঙ্গী নকলনবিশ সাইফুল ইসলাম। জেলা রেজিস্ট্রার শাহজাহান সরদার তাকে সঙ্গে নিয়ে সব জায়গায় চলাফেরা করেন। জেলা রেজিস্ট্রার ঢাকাসহ যশোরের বাইরে কোথাও গেলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। কোন দাওয়াতে গেলেও সাইফুল তার সঙ্গী হিসেবে থাকে। জেলা রেজিস্ট্রারের ঢাকার বাসায়ও সাইফুলের অবাধ যাতায়াত। টাটকা সবজি, মাছ রেজিস্ট্রারকে নিয়মিত সরবরাহ করে বলে থাকেন স্যার এগুলো আমার বাড়ির।
অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত এক এক্সট্রা মোহরারের মাসিক আয় সর্বোচ্চ তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বেশি না। কিন্তু জেলা রেজিস্ট্রারের আর্শিবাদে ফুলেফেঁপে উঠেছে সাইফুল। দামি মোটরসাইকেলে চলাফেরা করে এখন। ৪টি মাহেন্দ্রা থ্রি-হুইলারের মালিক হয়েছে সাইফুল। যশোর সাতমাইল রুটে সেগুলো ভাড়ায় চলাচল করে।
এছাড়া জেলা রেজিস্ট্রারকে টাকা দিয়ে ভাই, নাতিসহ আরো অনেক আত্নীয় স্বজনকে রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে সাইফুল। রেজিস্ট্রি অফিসে অস্থায়ী কর্মচারি হিসেবে দিন হাজিরা ভিত্তিক যারা কাজ করেন তাদের বেশির ভাগই সাইফুলের আত্নীয়-স্বজন।
আর সংরক্ষিত রেকর্ড রুমে কোন দায়িত্বে নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার জেলা রেজিস্ট্রারের। সেখানেও সাইফুল রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে একটি পদে তার নিজের লোক বসিয়েছেন। আশারাফ হোসেন নামে একজনকে সাইফুল রেকর্ড রুমের দায়িত্ব পাইয়ে দিয়েছে। আর তার মাধ্যমেই চলছে ভলিউম বই থেকে কেটে নেয়া, তফসিলের খুলে নেয়া পৃষ্ঠা পাচার।
আরো পড়ুন:
স্লোগানের নামে ভেল্কিবাজি
রেকর্ড রুমে ভুতের আছর!