অনিশ্চিত কপোতাক্ষ ব্রিজ
ইলিয়াস উদ্দীন: যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ লেনের উড়াল সেতুর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। তবে প্রথম সেতুটি আপাতত ভাঙ্গা হচ্ছে না। নদী থেকে উচ্চতা কম করে প্রথম সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। বিষয়টি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশ হলে দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। উড়াল সেতুর নির্মাণের কথাটি জানিয়েছেন সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ।
জাপান-বাংলাদেশ অর্থায়নে ৩৩০ কোটি টাকার ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রজেক্টের কাজ চলতি বছরের জুনেই শেষ হচ্ছে। একই প্রজেক্টের আওতায় ৯০ কোটি টাকার ঝিকরগাছা সেতুর নির্মাণ কাজের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো-ডেইনকো ৩৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ৫ প্রকল্পে কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর থেকে বেনাপোল সড়কের উন্নয়নের কাজসহ ৬ লেনের ঝিকরগাছা সেতু নির্মাণের কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সড়ক উন্নয়নের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হলেও ঝিকরগাছা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যাচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৬ লেন সেতুর মধ্যে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৫০ ফুট প্রস্থের ৩ লেন সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। সেতু নির্মাণের পরেই ধরা পড়ে বিআইডব্লিউটিএর গেজেট অনুযায়ী উচ্চতার ত্রুটি। বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে বর্তৃপক্ষ।
এরফলে এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে পরবর্তী ৩ লেনের সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, কপোতাক্ষ নদটি ‘গ’ শ্রেণিভূক্ত। সেজন্য এ নদের ওপর সেতু নির্মাণ করতে হলে পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হতে হবে ২৫ ফুট। অথচ ১৬ ফুট উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এরফলে নদী শাসন করে নদের নাব্যতা নষ্টের ষড়যন্ত্র পোক্ত করা হয়েছে। আমরা নদকে শাসন মুক্ত রাখতে নির্মাণ হওয়া সেতুটি অপসারণের দাবি জানিয়েছি।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর খুলনা বিভাগীয় যুগ্ম পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ ঝিকরগাছা সেতু নির্মাণের আগে আমাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়নি। এলাকাবাসীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখতে পাই পানির উচ্চ লেবেল থেকে গাডারের নীচ পর্যন্ত সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ ফুটের সামান্য কিছু বেশি উচ্চতায়। অথচ বিআইডব্লিউটিএর গেজেট অনুযায়ী ২৫ ফুট উচ্চতায় সেতুটি নির্মাণ হওয়া উচিত ছিল। এলাকাবাসীর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকারের সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। ২০২১ সালের আগস্ট থেকেই পরবর্তী সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে সেতু নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি সরকার যদি জাইকার সাথে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্ল্যান রিভিশন করে দ্বিতীয় সেতুর কাজ শুরু করে, তাহলে নির্মাণ কাজ আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরেই শেষ করা সম্ভব। যুক্তি হিসেবে তাদের দাবি হলো, নির্মাণ হওয়া সেতুটি ২৮ পাইলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অপর সেতু নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে ৭ পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই ২১ পাইলিংয়ের কাজ শেষ করেই সেতুর নির্মাণ কাজ ১ বছরের মধ্যেই সম্ভব বলে তাদের দাবি। একইভাবে নতুন সেতুর গাডারের পাশ থেকে প্রায় ৭ ফুট মাটি অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে নদের পানির উচ্চ লেবেল থেকে সেতুর প্রয়োজনীয় উচ্চতা ফিরে পাবে, এতে নদী শাসনমুক্ত হবে বলে দাবি করেন।
এ প্রকল্পের আওতায় ৬ লেনের সেতুর কাজ শেষ হলেই সেতুর দুই মুখে দুটি ফুট ওভার সেতু এবং ৬ টি আধুনিক এলইডি বাতির কারণেই এলাকায় দিন এবং রাতে একটি সুন্দর দৃশ্য বিরাজ করবে।
দ্বিতীয় সেতুর ব্যাপারে সংসদ সদস্য ডা. মেজর জেনারেল (অব.) নাসির উদ্দীন বলেন অনিয়মের মাধ্যমে একটা সেতু নির্মাণ হয়েছে। আমি দাবি করছি বিআইডব্লিউটিএর গেজেট অনুযায়ী ৬ লেনের দুটো সেতু নির্মাণ করা হোক।
সওজের নির্বাহী প্রকৌশল এবং এ প্রকল্পের ম্যানেজার আশরাফুজ্জামান বলেন, দ্বিতীয় সেতুর কাজ এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আশার কথা হলো, লাইন অব ক্রেডিট প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে ফরিদপুরের ভাঙা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার ৬ লেনের সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। ওই প্রকল্পের আওতায় ঝিকরগাছায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় কিলোমিটারের ৪ লেনের উড়াল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেতুটি ঝিকরগাছা বি এম হাইস্কুল থেকে শুরু হয়ে পারবাজার জোহরা মঞ্জিল পর্যন্ত শেষ হবে। বর্তমানের নতুন সেতুর ২১ ফুট উচ্চতায় উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ডিজাইন করা হয়েছে এবং একনেকে এ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে বলে আশরাফুজ্জামান জানিয়েছেন। তবে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের জন্য ভারত, চীন এবং এডিবির সাহায্য চাইতে পারেন বাংলাদেশ সরকার। অর্থের যোগান সাপেক্ষে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ ২/১ বছরের মধ্যে শুরু হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের ট্রাক ও ট্যাংক লরী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী সাহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঝিকরগাছা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন ভোমরা-বেনাপোল স্থলবন্দরের ৭-৮শ’ গাড়ি পণ্য পরিবহন করে। পরিবহনের চাপে প্রতিনিয়ত ঝিকরগাছায় যানজট লেগেই থাকে।
দেশের রাজস্ব আদায়ে বেনাপোল এবং ভোমরা স্থলবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমদানিকৃত ভারতীয় পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পৌঁছে দেয়ার জন্য ঝিকরগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের ওপর দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি ভুক্তভোগীদের।