৫৬৬ একর জমিতে হবে ৪৩৮ শিল্প প্লট
কর্মসংস্থান হবে দেড় লাখ মানুষের
ব্যয় ১ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যশোর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল-ইপিজেড প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল-বেপজা। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে করে আশার আলো দেখছেন এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। ইপিজেড-সংলগ্ন এলাকায় দেশি-বিদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। ফলে আপামর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বদলে যাবে যশোরের অর্থনীতির গতিপথ।
পরিকল্পনা কমিশন ও বেপজা সূত্রে জানা যায়, আইআইএফসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। বেপজা থেকে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি-পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্পের কিছু বিষয়ে আপত্তির পর তা সংশোধন করে অনুমোদন দেওয়া হয়।
আরও জানা গেছে, আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় স্টাডি ট্যুর ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে পিইসি সভায় এই দুই খাতে আপত্তি করে তা বাতিল করতে বলা হয়। তা আমলে নিয়ে বাতিল করে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও একটি জিপ গাড়ি, একটি পিকআপ ভ্যান ও একটি মাইক্রোবাস কেনার প্রস্তাব করা হয়। পিইসি সভায় এসব ব্যাপারে আপত্তি করলে জিপ গাড়ি বাতিল করা হয়েছে। আর কর্মকর্তাদের যাতায়াতে একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ভ্যান এবং একটি মাইক্রোবাস ভাড়ায় চালানোর কথা বলা হয়।
প্রকল্পটিতে অ্যাপায়ন ব্যয়, স্টেশনারি, সিল ও স্ট্যাম্প খাতে বেশি করে ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া ফ্রিজ, কম্পিউটার, স্ক্যানার কেনার ক্ষেত্রেও সঠিকভাবে সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। তাই পিইসি সভায় এসব ক্ষেত্রেও আপত্তি তুলে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়। আবার কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবনের কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তাই এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে বলা হয়। প্রস্তাবে নির্বাহী চেয়ারম্যানের জন্য আলাদা অফিস কক্ষ নির্মাণেরও কথা বলা হয়। পিইসি সভায় তা বাতিল করতে বলা হয়। বিশাল আকারের অফিসের প্রস্তাব করলে পিইসি সভায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অফিস স্পেশ ও ভাড়ার পরিমাণ বিদ্যমান সরকারি নীতিমালার আলোকে ৫ থেকে ৬ হাজার বর্গফুটের স্পেস করতে হবে। তা আমলে নিয়ে বেপজা থেকে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া এসি ও সিসিটিভি কেনার ক্ষেত্রেও অযৌক্তিক মূল্য ধরা হলে তা সংশোধন করতে বলা হয়।
আলোচ্য প্রকল্পে বিভিন্ন প্রস্তাবে আপত্তি করা হয় পিইসি সভায়। তা সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধিত ডিপিপি পাঠানো হলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের অনুমোদনের পর একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয় সম্প্রতি। প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা এর অনুমোদন দেন।
প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে চারটি ছয়তলা বিল্ডিং নির্মাণ, চারতলা একটি সিকিউরিটি ভবন, দ্বিতীয় তলা একটি আবাসিক মসজিদ নির্মাণ, ১০ তলা একটি বি-ক্যাটাগরির আবাসিক ভবন, ১০ তলা একটি ডি-টাইপের আবাসিক ভবন নির্মাণ, ছয়তলা একটি অফিসার্স ডরমেটরি ভবন ও ছয়তলা একটি স্টাফ ডরমেটরি ভবন, একটি চারতলা পুলিশ আউট পোস্ট ভবন নির্মাণ, একটি চারতলা কাস্টমস ভবন, একটি হেলিপ্যাডও নির্মাণ করা হবে। এসব ভবনের যাতায়াতে লিফট, সাব-স্টেশন, জেনারেটরসহ আরও অনেক কিছু নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের বেতন, বাড়িভাড়া, উৎসবভাতা, ভ্রমণভাতা, নববর্ষভাতা রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে সব কাজ শেষ করতে ১ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
এই এলাকার জমির দাম কম হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ খাতে খরচ কম হবে। তারপরও প্রকল্পের একক খাত হিসেবে ৫৬৬ একর ভূমি অধিগ্রহণেই সবচেয়ে বেশি ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যা মোট ব্যয়ের ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। এরপরই খরচ হচ্ছে ভূমি উন্নয়ন খাতে। ৮২ হাজার বর্গমিটার ড্রেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৭ কোটি ৬৩ লাখ, যা মোট ব্যয়ের ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ব্যয় হবে ভূমি উন্নয়নে। এখানে প্রায় ৭৪ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন করা হবে। তাতে ব্যয় হবে ২২৯ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। এ ছাড়া এইচবিবি রাস্তাও করা হবে চার লাখ বর্গমিটার। তাতে ব্যয় হবে ১৩৩ কোটি টাকা বা মোট ব্যয়ের ৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। সব কাজ শেষ করতে সরকার ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর বেপজার ৩৪তম বোর্ড সভায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যশোরে ইপিজেড স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চার বছর পর সরকার তাতে অনুমোদন দিল। ফলে পুরোপুরি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে যশোর ইপিজেড। এই এলাকায় ইপিজেড স্থাপিত হলে লাখো মানুষ কাজ পাবে। ইপিজেডের কারখানা মালিকরাও সস্তায় শ্রমিক পাবেন। এতে উভয়ই লাভবান হবে। যশোরের ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধ বিলসহ আশপাশের অকৃষি জমি অধিগ্রহণ করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রস্তাব অনুয়ায়ী, প্রায় ৫৬৬ একর জমিতে এই প্রকল্পে মোট ৪৩৮ শিল্প প্লট তৈরি করা হবে।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার গ্রেমবাগ ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া, মহাকাল, পোমবাগ, বালিয়াডাঙ্গা, আলডাঙ্গা আরাজি বাটিরঘাট, মাগুরা ও রাজাপুর মৌজায় ৫৬৫.৮৭১ একর ভূমিতে স্থাপিত হবে দেশের ১০ম এই ইপিজেড।
বেপজার নির্বাহী পরিচালক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়াজাত পণ্য, রাসায়নিক এবং ওষুধ শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে যশোর ইপিজেডে।
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত ইপিজেড স্থাপন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে।
ইপিজেডের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল কবির জানান, সম্প্রতি একনেক সভায় যশোর ইপিজেড প্রকল্পটির অনমোদন দেয়া হয়েছে। শিগগিরই শুরু করা হবে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে এই প্রকল্পটি।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি ও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যশোর সদর, অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে ভবদহ এলাকা। ভবদহ বিল পাড়ের ১২০ গ্রামের অন্তত ৫ লাখ মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। ওই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানে এখন পানি আছে। প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বনগ্রামের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, ভবদহের স্লুইসগেট গেটে পলি জমে পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যে কারণে ধলের বিলসহ দক্ষিণের প্রায় ২৭টি বিলের পানি জমে আছে। এসব বিলপাড়ের মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই এলাকায় ইপিজেড স্থাপিত হলে লাখো মানুষ কাজ পাবেন। ইপিজেডের কারখানা মালিকেরাও সস্তায় শ্রমিক পাবেন। লাভবান হবে উভয়ই।
প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বলেন, যশোরের দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভবদহের জলাবদ্ধতা। যুগের পর যুগ ক্ষতিগ্রস্ত এখানকার মানুষ। ইপিজেড স্থাপিত হলে এই এলাকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে জমির সম্ভাব্যতা যাচাই বাছায়ের কাজ শেষ হয়েছে।
যশোর চেম্বর অব কমার্সের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন জানান, সরকার যশোর ইপিজেড প্রকল্পের অনুমোদন দেয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আশার আলো দেখা দিয়েছে। কেননা প্রকল্পটি ঘিরে গড়ে উঠবে শিল্প প্রতিষ্ঠান। তখন জেলার অর্থনীতি বদলে যাবে।
যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তুষার কুমার পাল জানান, অনুমোদিত যশোর ইপিজেডের জন্য জমির সম্ভাব্যতা যাচাই বাছায়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। আমরা টাকা বরাদ্দ চেয়ে ইপিজেড কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। টাকা আসলে বাকি কার্যক্রম শুরু করা হবে।
২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যশোরের অভয়নগর উপজেলায় দেশের দশম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল-ইপিজেড স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।