আহনাফ ঈশান
শীতের হাওয়া যখন সাগরের বুকে নেমে আসে, তখন সেন্টমার্টিন দ্বীপ যেন নিজের ভেতরকার রঙগুলো আরও উজ্জ্বল করে তোলে। ডিসেম্বরের প্রথম সকাল—ঘাটে ভিড়ে থাকা পর্যটকবাহী জাহাজগুলোর গর্জন যেন দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে।
সমুদ্রের উপর টলমল করে ভেসে থাকা রোদ, বাতাসে লবণাক্ত ঘ্রাণ, আর ঢেউয়ের ছন্দে গা ছমছমে টান—সব মিলিয়ে দ্বীপ যেন বলে ওঠে, “আমি ফিরে এলাম আমার আপন রূপে।”
বহুদিন পর্যটকশূন্য থেকে নীরব ছিল এই প্রবালদ্বীপ। প্রশাসনের সীমাবদ্ধতার কারণে ছিল না রাতযাপনের অনুমতি, ছিল না ভ্রমণপিপাসুদের পায়ের শব্দ। কিন্তু সেই নীরবতা ভেঙে এবার আবারও মানুষ ছুটে আসছেন প্রকৃতির নীলতম রূপ দেখতে।
কক্সবাজার থেকে ছয় ঘণ্টার নৌযাত্রার ক্লান্তি যেন মুছে যায় মুহূর্তেই, যখন জাহাজ থেকে নামতেই চোখে পড়ে অসীম নীল জলের স্বচ্ছ সৌন্দর্য।
অবাক বিস্ময়ে পর্যটকদের প্রথম সাক্ষাৎ
পর্যটক রেহেনা আক্তার প্রথমবার দ্বীপ দেখে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ান।
“জাহাজ থেকে নামতেই মনে হলো, আমি যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসেছি। সমুদ্রের জলরাশি এতটা স্বচ্ছ—হৃদয় পর্যন্ত নীল হয়ে যায়।”
রায়হান কাদেরীর অনুভূতিও কিছুটা একই—
“এবার সেন্টমার্টিনকে অন্যরকম লাগছে। চারপাশ পরিষ্কার, পানিও খুব স্বচ্ছ। যেন প্রকৃতি নিজেকে আবার গোছানো সাজে সাজিয়েছে।”
রবিউল ইসলাম আরও গভীর অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন—
“আমরা যে নীল জলরাশির স্বপ্ন দেখি, সেটা এখন এখানে সত্যি মনে হচ্ছে। হয়তো প্রকৃতিকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়াই তার সৌন্দর্য ফিরিয়ে এনেছে।”
দ্বীপবাসীর মুখে আবারও হাসির ঝিলিক
পর্যটক আসা মাত্রই সেন্টমার্টিন বাজার এলাকার দৃশ্যপট বদলে যায়।
রাস্তায় ভ্যানের ঘণ্টা বাজে, ডাব বিক্রেতার ডাক শোনা যায়, বার্মিজ দোকানিরা রঙিন পণ্য সাজায় আর সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁগুলোতে ভেসে আসে সি-ফুডের সুবাস।
ভ্যানচালক ছৈয়দ আলমের কণ্ঠে আনন্দের কম্পন—
“এতদিন শুকনো দিন গেছে। এখন আবার ঘাটে জাহাজ ভিড়ছে, মানুষ আসছে—মনে হচ্ছে জীবন আবার এসে ধরা দিয়েছে।”
রেস্তোরাঁ শ্রমিক আব্দুর রহিম বললেন—
“পর্যটক দেখলেই আমাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এ ব্যস্ততা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।”
প্রকৃতি রক্ষার অঙ্গীকারে নতুন পথচলা
নতুন মৌসুমে পর্যটকদের জন্য রয়েছে ১২টি নির্দেশনা। দ্বীপের পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে এসব নিয়ম মানাতে নিজ উদ্যোগে কাজ করছেন স্থানীয়রা। তারা পর্যটকদের সচেতন করছেন, সাগরপাড় পরিষ্কার করছেন, প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছেন—সবই প্রকৃতিকে ভালোবেসে।
কিন্তু দ্বীপের মানুষের আরও বড় দাবি—পর্যটন মৌসুম যেন শুধু ২ মাসে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং ৪ মাস উন্মুক্ত থাকে।
ইটাবের সাধারণ সম্পাদক দ্বীন ইসলাম রাজ বলেন—
“পর্যটন বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষা হয় না। বরং পরিকল্পিত পর্যটনই পরিবেশকে বাঁচায়। তাই অন্তত ৪ মাস দ্বীপ খোলা থাকা উচিত।”
হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি এম এ আবদুর রহিম জিহাদীর হিসাব আরও বাস্তবধর্মী—
“১০ মাসের ক্ষতি ২ মাসে পূরণ করা যায় না। দ্বীপবাসীর বেঁচে থাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন দরকার।”
বৃহত্তর স্বপ্ন : ৮ বর্গকিলোমিটারের নীল পৃথিবী
মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে বসবাস করেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন পর্যটন। পর্যটকের কণ্ঠের হাসি, জাহাজের সাইরেন, বাজারের কোলাহল—এসবই দ্বীপবাসীর জীবনের রক্তস্রোত।
শীতের রোদে ঝলমল করতে থাকা সাগর, নীল আকাশের ওপারে উড়ে যাওয়া সীগাল, আর ঢেউয়ের অন্তহীন ছন্দ—সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিন আজ আবারও হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত স্বপ্নদ্বীপ।
যেখানে প্রতিটি সকাল যেন বলে—
“এসো, প্রকৃতিকে একটু ভালোবাসো; সে তোমাকে আরও রঙিন করে ফিরিয়ে দেবে।”
