রায়হান সিদ্দিক: এসো ভাই ভুলে যাই জাতি বর্ণ বিদ্বেষ, সারা বছর মিলেমিশে থাকবো মোরা বেশ ,পান্তা ইলিশ, পিঠাপুলি আর বৈশাখী মেলায়, নাচে গানে উল্লাসে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। পুরাতন জীর্ণ মলিনতা ধুয়ে মুছে, সুন্দর আগামীর অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক- বাহক যশোর শহরে সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ -১৪২৯।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে দু’বছর সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও জাতীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধ্যবাদকতা থাকায় জনজীবনে ছিল না কোন আনন্দ উচ্ছ্বাস। তাই দু’বছর পর পালিত বাঙালি সমাজের প্রাণের উৎসব নববর্ষে দেখা যায় মহা আনন্দের মিলনমেলা। সাংস্কৃতিক শহর যশোর থেকেই প্রথম শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার সেই ঐতিহ্য আজও অক্ষুন্ন রয়েছে তা এবারও প্রমান হয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি, ঘোড়ায় চড়ে রাজা রানির শহর ভ্রমণ সহ গ্রাম বাংলার নানা বৈচিত্রময় দৃশ্য ফুটে ওঠে এবারের শোভাযাত্রায়। এছাড়াও শোভাযত্রায় দেখা মেলে হাতি, ঘোড়া, পাখির সমারহ। শত শত মানুষের ঢল নামে মঙ্গল শোভাযাত্রায় । রাস্তার রাস্তার মোড়ে মোড়ে রঙ তুলি নিয়ে অপেক্ষারত শিল্পীদের হাতেও জীরন নেই । নানা রঙের পাঞ্জাবী আর নারীরা শৈল্পীক হাড়ি পড়ে অংশ নেয় এই শোভাযত্রায়। পাশাপাশি শিশুদের কলরবও ছিলো শোভাযাত্রায়। সব মিলিয়ে দু’বছর পর বাঙালির সর্বজনীন এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে যশোরে।
এদিন সকাল সাড়ে ৬টায় যশোর শহরের পুরাতন বিদ্যাপীঠ মুসলিম একাডেমি চত্বরে পুনশ্চের শিল্পীদের সুরের মুর্ছনায় আন্দোলিত হয় শ্রোতারা। প্রায়ই একই সাথে যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বৃক্ষের তলে সুরবিতানের বাদ্য সুরে আলো ছড়ায়। সকাল সাতটায় পৌর পার্কের শিশুদের নৃত্য গীতি ও ছন্দে বৈশাখীর মাতাল হাওয়ায় দোলা লাগায় উদীচী জেলা সংসদ ও রাজ্জাক কলেজ প্রাঙ্গনে তির্যক যশোরের শিল্পীরা ।
গত ৪৮ বছর ধরে যশোরের পৌর উদ্যানে প্রভাতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে উদীচী জেলা সংসদ। এবছরও ৭টা ১মিনিটে পৌর উদ্যানে বৈশাখী আয়োজন শুরু হয়। সংগঠনের ৩শ শিল্পীর সমন্বয়ে সাড়ে তিন ঘন্টার আয়োজনে পঞ্চ কবির গান, শিশুতোষ অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশন হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও দেয়া হয় ডা. রবিউল বর্ষ বরণ পদক ১৪২৯। এবছর পদক পেয়েছেন নাট্যভিনেতা সমু চৌধুরী। তার হাতে পদক তুলে দেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। এসময় উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, পৌর মেয়র হায়দার গণী খান পলাশ, দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক ও উদীচীর অন্যতম উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ দ্দৌলা সহ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সময় সল্পতার কারনে এবছর হয়নি যাত্রাপাল।
যশোর জেলা বর্ষবরণ পরিষদের আমন্ত্রণে সকাল সাড়ে সাতটায় টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বৃক্ষ তলে এসেছিলো যশোর জেলার কমপক্ষে ২৫/ ৩০ টি সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারন সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলুর উপস্থাপনায় যশোরের সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন আবৃত্তি, গান ও নৃত্যের যে কোন একটি করে উপাস্থপন করেন। বিবর্তন যশোরের আবৃত্তির মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালির সর্ববৃহৎ প্রাণের উৎসব বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।
সকাল ৯টার পরে মঞ্চে আসেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিডিএলজি হোসাইন শওকতসহ উদযাপন পর্ষদের আহবায়ক সুকুমার দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম, হারুন অর রশীদ,ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু, অ্যাডভোকেট মাহমুদ হাসান বুলুসহ সাংস্কৃতিক জন। সুকুমার দাস স্বাগত বক্তব্য দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধনী আলোচনা শুরু করেন । এরপর পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়র্দার ও জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বক্তব্য রাখেন ও শোভাযাত্রার উদ্ধোধন ঘোষনা করেন।
যশোর টাউন হল ময়দানে জেলা প্রশাসন ও বর্ষবরণ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা সত্যিকার অর্থে পহেলা বৈশাখ উৎসবে যোগ করে নতুন মাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি টাউন হল ময়দান থেকে শুরু করে দড়াটানা মোড় হয়ে চিত্রার মোড় দিয়ে পুনরায় টাউন হল ময়দানে এসে শেষ হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনগণ। শোভাযাত্রায় বাঙালির ঐতিহ্যকে তুলে ধরে নান্দনিক উপস্থাপনায় পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায় চারুতীর্থ, নাট্যকলা সংসদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, নন্দন ও তির্যক যশোর।
পরিশেষে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় যশোরের পুলিশ সুপার সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন,এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে নির্বিঘœ করতে সম্পূর্ণ যশোরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলা পুলিশের প্রতিটি ইউনিট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পোশাকের পাশা-পাশি আমরা বিপুল সংখ্যক সাদা পোশাকের পুলিশও নিয়োজিত করেছি।
যদি কেউ কোন রকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীদের ইভটিজিং রোধে শহরে জুড়ে নেয়া হয়েছে বিশেষ নজরদারি।
জেলা প্রশাসক তার সংক্ষিপ্ত বক্তবে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, জেলা প্রশাসন ও নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আহ্বানে যশোরের সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহণই বাংলাদেশকে অসম্প্রদায়িক ও সোনার বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে।