রড সিমেন্ট বালু পাথরের দাম উর্ধ্বগতি
স্মরণকালের মহাসংকটে ঠিকাদাররা
সুনীল ঘোষ: পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম। সর্বোচ্চ দর উঠেছে রডে। পিছিয়ে নেই ইট, বালু, সিমেন্টসহ পাথর। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে দাম। ফলে স্বল্প সঞ্চয়ী মানুষের বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বিপাকে পড়েছেন ঠিকাদাররাও। অনেকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই বিল পাচ্ছেন না। নির্মাণ কাজে স্মরণকালের মহাসংকট দেখা দিয়েছে বলেও মন্তব্য ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের।
যশোর ঠিকাদার সমিতির সভাপতি রেজাউল হক বিন্দু দৈনিক কল্যাণকে জানান, বৃহত্তর যশোর প্রকল্পের (জেআরআইবিপি) কাজ করে ৩ বছরেও বিল পাইনি। আয়কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যখন টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলাম তখন রডের সর্বোচ্চ কেজি ছিল ৫৩ টাকা। এখন গ্রেড-নন গ্রেড ও কোম্পানি ভেদে রডের দাম উঠেছে ৯৬ টাকা থেকে ১০১ টাকা পর্যন্ত। ৯ হাজার টাকার বিটুমিন কিনতে হচ্ছে ১১ হাজারে। পাথরের দাম ডাবল হয়েছে। ভারতের কালো পাথরের আমদানি কমে গেছে। ১২০ টাকা সেপটির পাথর কিনতে হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। ৪২০ টাকা বস্তার সিমেন্ট ৫শ ছুঁয়েছে।
তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে পরিবহন খরচ। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকারের মেগা প্রকল্পে দর বাড়িয়ে নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ নেই। সবকিছুর দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় অনেক ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারছেন না। মাঝপথে থমকে গেছে নির্মাণ কাজ। সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসার উপক্রম দেখা দিয়েছে।
ঠিকাদার আক্তার হোসেন রাজা বলেন, এবার সব হারিয়ে ফেলেছি। সারাজীবনের রোজগারের অর্থ ব্যয় করেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রড, সিমেন্ট, পাথর ও বালুসহ নির্মাণ সামগ্রীর দাম। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতিকেজি রডে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। প্রতি বস্তা সিমেন্টে কোম্পানি ভেদে বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার তাগিদ আসছে। অন্যথায় সিকিউরিটি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, যশোরে এলজিইডি’র ৫শ’ ঠিকাদার রয়েছেন। এখন কেউ ভাল অবস্থায় নেই। বিষয়টি মানবিক দাবি করে তিনি সরকার প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
যশোর-নড়াইল বাসস্ট্যা-ের পাশে সেতু স্টিল কর্পোরেশনের মালিক আসিফ সেতু বলেন, চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। তবে করোনা প্রাদুর্ভাব ও ইউক্রেনের যুদ্ধ দাম বৃদ্ধির কারণ বলছেন। কাচা মালের ঘাটতি দাম বৃদ্ধির কারণ বলেও মনে করেন তিনি।
যশোর শহরের পাইপপট্টিতে অবস্থিত যমুনা স্টিল হাউজের। পাইকারি ও খুচরা দরে রড-সিমেন্ট বেচাবিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান দৈনিক কল্যাণকে বলেন, চট্টগ্রামে তৈরি প্রতি কেজি রড এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, পক্ষকাল আগেও এই রডের দাম ছিল ৭১ থেকে ৭৮ টাকা। একেএস, বিএসআরএম ও কেএসআরএম রডের চাহিদা বেশি। এসব কোম্পানির রড ব্রান্ড। গ্রেড-নন গ্রেড ও কোম্পানি ভেদে দামে কিছুটা কম বেশি আছে। তিনি বলেন, সিমেন্টের দামও বেড়েছে। তিনিও মনে করেন চট্টগ্রাম ভিত্তিক সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়েছে। বেশ কয়েকজন ঠিকাদারের অভিযোগ স্থানীয় পর্যায়েও সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা দাম বাড়িয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দায় চাপাচ্ছে। এরফলে হাতে-গোনা কিছু রড বিক্রেতা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। কিন্তু মরতি মরণ হচ্ছে আমাদের।
যশোর শহরের পিটিআই রোডে রয়েছে খুচরা ইট-বালু, খোয়া ও সিমেন্ট বিক্রির দোকান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোসলেম উদ্দিন মুঠোফোনে জানান, বৃহস্পতিবার প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি ট্রাক (দুই হাজার) ইটে বেড়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এক মাস আগেও খাজুরাসহ মাগুরা সড়ক সংলগ্ন কিছু ভাটার ইট ১৪ থেকে ১৬ হাজারে কেনা গেছে। এখন ২০ হাজারেও মিলছে না।
তিনি বলেন, যশোর শহরের আশপাশে অসংখ্য ভাটা রয়েছে। এরাও সিন্ডিকেট করে ১৮ হাজার টাকার ইটের দাম বাড়িয়ে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। এতো দামে ইট কিনে আসল উঠছে না। বাকিতে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ বাড়ি-ঘর নির্মাণ শুরু করে বিপাকে পড়েছেন। বাড়ি বানানোর স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
যশোর সদরের শেখহাটি গ্রামের দীনবন্ধু বিশ্বাস জানান, গত বছর বাড়ি শুরু করেছিলাম। মাস তিনেক আগে দো-তলার ছাদ দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে ইটের বেড়া দেয়া সম্ভব হবে না। ইট-বালু ও সিমেন্টের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি বলেন, সখ পূরণে দো-তলার কাজে হাত দেয়া ভুল হয়েছে। বাড়ি বানানোর স্বপ্নচারী কনেচপুর গ্রামের মিল্লাত হোসেন বলেন, আমি যখনি বাড়ি বানানোর কাজে হাত দিলাম তখনি বেড়ে গেল সবকিছুর দাম। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ জীবনে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন পূরণ হবে না। এখানে কোনো কিছুর দাম বাড়লে তা আর কমে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইটের দাম বেড়েছে স্বীকার করে যশোর ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কাজী নাজির আহমেদ মুন্নু বলেন, প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ছিল ৭ থেকে ৯ হাজার টাকা। এবার কিনতে হয়েছে ১৯ হাজার ৭শ টাকা থেকে শুরু করে ২৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাও কয়লার মান ভাল না। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতসহ বেশকিছু দেশ থেকে কয়লা আসে। বসুন্ধরা, উত্তরা, আফিল, সাহারা, নওয়াপাড়া ও জয়েন্ট গ্রুপসহ সারাদেশের ১২/১৩টি প্রতিষ্ঠান কয়লা আমদানি করে। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ালে আমাদের কিছুই করার থাকে না। তিনি বলেন, শহরের আশপাশের ভাটাগুলোতে ইট উৎপাদনে খরচ বেশি। তবে গ্রামাঞ্চলে মাটির সহজলভ্যতা রয়েছে। সেখানে দামও একটু কম। বর্তমানে যশোরে প্রতি ট্রাক (দুই হাজার) ইট ১৯ হাজার থেকে শুরু করে ২৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান এই নেতা।
যশোরে খোকন হোসেন নামে এক ফ্লাট বিক্রেতা জানান, অক্টোবর থেকে ফেব্রয়ারি পর্যন্ত ভবন তৈরির প্রধান মৌসুম। এ সময়ে আবাসন খাতসহ ব্যক্তি পর্যায়েও ভবন নির্মাণের কাজ বেশি হয়। সাধারণত এই মৌসুমে নির্মাণসামগ্রীর দামও তুলনামূলক কম থাকে। কিন্তু এবার দেখছি উল্টো। এ নিয়ে আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বাড়তি ব্যয়ের চাপে অনেক ডেভেলপারের কাজ মাঝপথে বন্ধ রয়েছে। রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ মেটাল বা মেল্টিং স্ক্র্যাপের দাম বিশ্ববাজারে এখন বেশি। গতবছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে এই মেটাল কিনতে হচ্ছে। দাম বেড়েছে ইটভাটায় কাঁচা ইট পোড়ানোর একমাত্র বৈধ জ্বালানি কয়লারও। তিনি বলেন, কয়লা বিক্রি সিন্ডিকেটের কারণে এই জ্বালানির দাম টন প্রতি দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে স্বভাবতই ইটের দামও চড়া।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জানান, তাদের পিপিআর ফলো করতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু করার নেই। তবে সরকার চাইলে অনেক কিছুই হতে পারে। তবে সম্ভাবনা কম। তিনি মনে করেন, এই উর্ধ্বগতি থাকবে না। সিডিউল টাইমেই কাজ সম্পন্ন হবে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।