দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ
বিশাল বহুতল স্কুলভবন, ঝকঝকে-চকচকে ওয়াশরুম আর অবিরাম পানিরকল পাল্টে দিচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনব্যবস্থা। স্কুলের সময় হবার আগেই বইখাতার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ওরা এখন পৌঁছে হাজির হচ্ছে স্কুলে। অনেকের সাথে আবার টিফিনও থাকছে। দেরি করলে পেছনের বেঞ্চে বসতে হবে তাই আগেভাগেই ওরা রওনা দেয় স্কুলে। পেসাব-পায়খানা, পানির কল সবই এখন স্কুলের ভেতর। এত কম বয়সেই ছেলে-মেয়েরা এখন পেসাব-পায়খানা ব্যবহার, পরিষ্কার রাখা শিখে যাচ্ছে আর এতে তাদের বাড়ির পরিবেশও ভালো হয়ে যাচ্ছে। এতে যেসব স্কুলে ঝরেপড়ার মত একটা অশুভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে, বাড়ছে স্কুলগামি শিশুদের হার। এ চিত্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহের।
জেলার শৈলকুপা উপজেলার হাবিবপুরে জাবালুন নূর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ হলো। এদের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাপলা খাতুন ও জান্নাতি খাতুন জানায়, আগে তাদের স্কুলে ভালোমানের ওয়াশরুম না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই অনেকেক্ষেত্রে নিকটস্থ বাড়ি বা নিজেদের বাড়িতে চলে যেত। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আর ক্লাসে ফিরে আসত না। এখন স্কুলভবনেই উন্নতমানের পেসাব-পায়খানা আর হাত ধোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে সব ছাত্রছাত্রীই সাবান দিয়ে দুই হাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন থাকে। এটা ভালোভাবে না করলে শিক্ষকদের ধমক খেতে হয়।
জাবালুন নূর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অঞ্জু রাণী বিশ^াস জানালেন, ১৪০ জন শিক্ষার্থীর ৬৯ জন মেয়ে এবং বাকি ৭১ জন ছেলে যারা ৬ নারী শিক্ষকের কাছে পাঠ নিচ্ছে। দো’তলা ভবন, সাথে বালক-বালিকাদের পৃথক ওয়াশরুম। ছেলেদের জন্য দো’তলায় আর মেয়ে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষককদের জন্য নিচতলায়। এছাড়াও নিচতলাতেই রয়েছে হাত ধোঁয়া আর বিশুদ্ধ পানির ট্যাব। শিশুরা সেসব ব্যবহার করছে প্রয়োজনমত। সেখানে রয়েছে সাবান আর জীবানুনাশক হ্যান্ডওয়াশ বা তরল সাবান। এসব সুবিধার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার কিছুটা কমলেও স্কুলে ঢোকা ও বের হবার মাত্র দু’হাত চওড়া কাঁচারাস্তায় রিকসাও ঢোকে না। আর বৃষ্টি হলেতো হেঁটেও স্কুলে যাতায়াত করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলের সীমানা বেষ্টনীও নেই এ স্কুলে। ফলে গরু-ছাগল আর একশ্রেণির বখাটের উৎপাত তাদের সহ্য করতে হয়, লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
ওই স্কুলের অভিভাবক শহিদুল ইসলাম ও কয়েকজন স্থানীয়ের মতে, প্রাইমারি স্কুলে দিনদিন নারী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ায় স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ বেশ উন্নত হচ্ছে। পুরুষ শিক্ষকদের অনেকেই হয়ত রাজনীতি বা অন্য কোন সামাজিক কাজ বা দাপ্তরিক কাজে জেলা বা উপজেলা পর্যায় অফিসে যাবার কথা বলে প্রতিষ্ঠানে সময় কম দিতেন, আর এখন নারী শিক্ষকরা সেসব থেকে পুরোপুরি মুক্ত বিধায় সার্বক্ষণিক স্কুলেই সময় দেন।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আনন্দ কিশোর জানান, এ জেলায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৯শ ৭টি। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদরে ২১৫টি, কালিগঞ্জে ১৫০টি, কোটচাঁদপুরে ৭৪টি, সীমান্তবর্তী মহেশপুরে ১৫২টি, শৈলকুপায় ১৮১টি এবং হরিণাকুন্ডুতে ১৩৫টি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে যেখানে দেড়শ’ থেকে আড়াইশ’ শিশুশিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। ভাঙা টিনের চালা, ছাপড়া আর বেড়ার বদলে এখন গ্রামেও শোভা পাচ্ছে একতলা, দো’তলা বা তিনতলা ভবন, সাথে বালক-বালিকাদের পৃথক ওয়াশরুম। ছোটখাটো সমস্যা থাকলেও গ্রামের প্রাইমারি স্কুলগুলোর অধিকাংশই এখন পরিবেশসম্মত পাঠদান হচ্ছে। অল্প দু-এক বছরের মধ্যে দেশের সব প্রাইমারি স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে, পরিবেশ আরো উন্নত হবে আর শিশু শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত ও দীক্ষিত হয়ে সুনাগরিক হিসেবে দেশের হাল ধরবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আনন্দ কিশোর সাহা।