কল্যাণ ডেস্ক
প্রায় একই সময়ে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল দুই সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তার ঢাকা সফর সরকারকে সংকট মোকাবিলার সাহস জুগিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষকরা।
তারা বলেছেন, এই দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশকে নিয়ে যে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন এবং ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার ওপর ভর করে অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দিতে পারবে সরকার; বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আর কমবে না। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে যে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। ফিরে যান ১৭ জানুয়ারি। পাঁচ দিনের এই সফরে অ্যান্তইনেত মনসিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরই এক বিবৃতিতে আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, ‘আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ ৩০ জানুয়ারির বৈঠকেই বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করার বিষয়টি বিবেচনা করবে।’ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৬ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার ডলার পেতে পারে বলে আশা করছে সরকার।
মনসিও সায়েহর ঢাকা সফর শেষ হতে না হতেই ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে অংশীদারত্ব সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি এবং বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জন উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদার, রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া তিনি বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার।
আরও পড়ুন: ঝুঁকিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিশ্বব্যাংক এমডি ঢাকা ছেড়েছেন বলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের জ্যেষ্ঠ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেহরিন আহমেদ মাহবুব দৈনিক বাংলাকে জানিয়েছেন।
প্রায় একই সময়ে বিশ্বব্যাংক এমডি ও আইএমএফের ডিএমডির বাংলাদেশ সফরকে ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফের ঋণটা পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
৩০ জানুয়ারি সংস্থাটির বোর্ডে ঋণটি অনুমোদনের পর ফেব্রুয়ারির মাঝমাঝিতেই প্রথম কিস্তি পাবে বাংলাদেশ। তখন রিজার্ভ বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বাড়ছে। তাতে রিজার্ভ আর বাড়বে। আমার মনে হয়, রিজার্ভ আর কমবে না; বাড়তেই থাকবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের এমডিও বাংলাদেশের উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচনসহ নানা বিষয়ে সরকারের প্রশংসা করেছেন। একই সঙ্গে সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকারও করেছেন।’
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এমডির এই সফরের আলাদা গুরুত্ব আছে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে তিক্ত ঘটনার পর এটা বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ কোনো কর্মকর্তার ঢাকা সফর।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ কিন্তু একই গ্রুপের সদস্য। কোনো দেশকে নিয়ে আইএমএফ ইতিবাচক মনোভাব দেখালে বিশ্বব্যাংক সেটিকে বিবেচনায় নেয়। আবার বিশ্বব্যাংক যে মূল্যায়ন করে, আইএমএফও সেটিকে গুরুত্ব দেয়। এই দুই সংস্থা যেহেতু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এতে সরকার সাহস পেয়েছে, এই সাহসের খুব দরকার ছিল।’
একই কথা বলেছেন অর্থনীতির আরেক গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশে আইএমএফের ঋণ আস্থার সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে এআইআইবি ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই দুই সংস্থার ঋণ দ্রুত পাওয়া যাবে। আমার মনে হচ্ছে, এসবের ওপর ভর করে বাংলাদেশ চাপ সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।’
বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণা
গতকাল রাতে ঢাকা ছাড়ার আগে এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বব্যাংকের দৃঢ় সমর্থনের বিষয়টি আবার নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতিপথ অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণা। দেশটি অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বর্তমানের এই জায়গায় এসেছে। দারিদ্র্য হ্রাস করেছে এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনে একটি অগ্রণী এবং উদ্ভাবনী ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বব্যাংক গত পাঁচ দশক ধরে একটি অবিচল অংশীদার এবং বাংলাদেশকে সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জনে সহায়তা করে এসেছে। ভবিষ্যতে এ সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
আরও পড়ুন: চাপে দিশেহারা ভোক্তারা: ২০২২ সালে দাম বেড়েছে সব পণ্যের
ভ্যান ট্রটসেনবার্গ গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা এবং ২০২০-২০২২ সালের মধ্যে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ফোরামের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
বিশ্বব্যাংক এমডি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ১৯৭১ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়জনিত মৃত্যু ১০০ গুণেরও বেশি কমিয়ে সাহসী ও উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বিশ্বব্যাপী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ গতকাল কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং প্রায় ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানান। বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ৫৯ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে।
ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক করোনা মহামারির প্রভাব এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রভাবসহ বৈশ্বিক ধাক্কার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করছে এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে বাধাগুলো দূর করতে সাহায্য করছে।
আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর জন্য আমরা আরও বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি উন্নত করতে এবং জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করব।’
আরও পড়ুন: চার ধাপে বেড়ে এখন ধীরমুখি রসুনের দাম