দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ: ভয়াল কামান্না দিবস আজ। এ দিনে ঝিনাইদহের তৎকালিন শৈলকুপা থানা সদর থেকে ৮-৯ মাইল পূর্বদিকে কুমার নদী ঘেঁষে কামান্না গ্রামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহিদ হন ২৭ মুক্তিপাগল যুবক ও এক গৃহবধূসহ ২৯ ব্যক্তি।
বগুড়া ইউনিয়নের সবুজে ঘেরা এ গ্রামটিতে ঘটে যায় ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ও ঘৃণ্যতম ঘটনা। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছরের মত এবারও পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক কামান্না দিবস।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে ৩৫ জনের মত স্বাধীনতাকামি যুবক সেনা কর্মকর্তা শমসের হোসেনের নেতৃত্বে আশ্রয় নেন কামান্না হাইস্কুলের পশ্চিমদিকে মাধব ভৌমিকের বাড়িতে ও পাশের কিরণ শিকদারের বাড়িতে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবরটি পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক পৌঁছে দেন। খবর পেয়ে তৎকালিন মহকুমা শহর ঝিনাইদহ, থানা শহর শৈলকুপা আর পার্শবর্তী মাগুরা থেকে কয়েকশ হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের স্থানীয় সহচর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস মাঝরাত থেকেই ঘিরে ফেলে মাধব ভৌমিকের বাড়ি, আশেপাশের এলাকা।
এবং ভোর রাতের দিকে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে দামাল ছেলেদের ওপর। হায়েনাদের গুলি আর বেয়নেটের আঘাতে ঝরে পড়ে একে এক ২৭ মুত্তিপাগল যুুুুুবক, কামান্নার ব্যবসায়ি কিরণ শিকদার আর গৃহবধূ রঙ্গনেছা। এ সময় আহত হন আরো অনেকে।
আহত আব্দুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে ওই সময় মায়ের মমতায় সেবা দিয়েছিলেন পানু কাজির মা রাবেয়া খাতুন ওরফে সোনা কাজি, ছোট বোন বেনু এবং কাজি সিরাজ নিজে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পর বারইহুদা গ্রামের কলেজছাত্র বিশ^াস লুৎফর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে ছয়টি গণকবরে সমাহিত করেন মোমিন, কাদের, শহিদুল ইসলাম, সলেমান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল ওয়াহেদ, রিয়াদ, আলমগীর হোসেন, আব্দুল মোতালেব, আলী হোসেন, শরিফুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, আলিমুজ্জামান, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান, নাসিম, রাজ্জাক-২, কওসার আলী, আব্দুল মালেক, আব্দুল আজিজ, আকবর হোসেন, সেলিম, হোসেন, রাসেদ, গোলজার আহমেদ, অধির ও গৌরকে। এদের অধিকাংশই মাগুরা জেলার হাজিপুর ও শ্রীপুর উপজেলার সন্তান। পরবর্তীতে গণকবরস্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় এবং শহীদ ২৭ মুক্তিযোদ্ধার ও গৃহবধূ রঙ্গনেছার নাম।
কামান্নায় ২৭ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ও গণকবর ঘিরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ ও এলাকাটিকে দেশের সব মানুষের কাছে মুত্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবহিত করা এবং একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের। গতবছর (২০২১) কামান্নায় ২৭ শহীদ স্মৃতি দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাড়িটির মালিক পানু কাজির ছেলে লেফটেনেন্ট কর্ণেল কাজি শাহিনুজ্জামান রাসেল পাঁচ শতাংশ জমি দান হিসেবে লিখে দেন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের নামে।
কামান্নায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মিত হবে এ কারণে জমিটি লিখে দেয়া হয় বলে জমিদাতা কাজি শাহিনুজ্জামান রাসেল জানান। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার ভূমি পার্থপ্রতীম শীল দানকৃত জমির দলিল বুঝে নেন।
কামান্না দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান লাল জানান, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতি সংঘের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শৈলকুপা উপজেলা কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) বনি আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সভায় ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই দিনব্যাপি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন। শৈলকুপা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম আব্দুল হাকিম আহমদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শৈলকুপা উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার রহমত আলী মন্টু এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শ্রীপুর উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বিশ^াস ইকরাম আলী বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিৎ থাকবেন।