যশোর জেলা রেজিস্ট্রি অফিস
অবাধে চলছে দুর্নীতি — ২
সালমান হাসান: যশোর রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুম অরক্ষিত। নতুন করে সক্রিয় পাতা ছেড়া চক্র। সংরক্ষিত কক্ষ রেকর্ড রুমে চক্রটির অবাধ যাতায়াত। ভলিউম বই থেকে জমির মূল দলিল ছিড়ে নিয়ে ঘটাচ্ছে জমির মালিকানার অপমৃত্যু। স্পর্শকাতর ওই কক্ষটিতে ঢোকার ক্ষেত্রে অফিসের কর্তাব্যক্তিদেরও রেকর্ড কিপারের সম্মতি নিতে হয়। কিন্তু চক্রটির সেখানটায় প্রবেশ অপ্রতিরোধ্য। সাব রেজিস্ট্রার ও জেলা রেজিস্ট্রারের সাথে সখ্যতা থাকায় রেকর্ড রুমে তাদের যাতায়াত অবারিত।
রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুমে চলছে ভুতের আছর! বিগত দিনগুলোর মত রেকর্ড রুমে তছনছ করছে পাতা ছেড়া চক্র। ভলিউম বই থেকে দলিলের পৃষ্ঠা কাটাছেড়া করছে। তফশিল লেখা পাতা খুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নতুন পাতা। অফিসটির কর্মরত ও সাধারণ দলিল লেখকদের এ রকমই ভাষ্য।
ভলিউম থেকে দলিলের পাতা কাটাছেড়া ও মূল পাতা খুলে দেয়া হয় নতুন পাতা
জমির মালিকানার অপমৃত্যু
সাব রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রারের সাথে চক্রের বিশেষ সখ্যতা
তারা বলছেন, স্পর্শকাতর কক্ষ রেকর্ড রুমে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। রেকর্ড কিপার ও পিওন ছাড়া অন্য কেউ রুমটিতে ঢুকতে পারেন না। বড়কর্তাদের ঢুকতে হলেও রেকর্ড কিপারের সম্মতি লাগে। তাহলে এরকম সুরক্ষিত কক্ষ থেকে জমির দলিল ও তফশিলের মত গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব করছে কারা? এমন প্রশ্ন শুনে দলিলের পাতা ছেড়ার মত ভয়ঙ্কর ও শিউরে ওঠার ঘটনার সূত্ররা রসিকতা ভরে বলেন, ভুতেরা! রেকর্ড রুমে ভুতের আছর লেগেছে! তাদের ভাষ্যমতে, মোহরার শামছুজ্জামান মিলন (সম্প্রতি বাঘারপাড়ায় বদলি) ও নকলনবিশ সাইফুল ইসলাম এই পাতা ছেড়ার ভুতদের হোতা। তাদের নেতৃত্বে একটি চক্র রেকর্ড রুম তছনছ করছে। ভলিউম রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা হয় জিম্মি, না হয় টাকার কাছে বিক্রি-এমন দাবি করেছেন তারা।
বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সরকারি অফিসের মূল্যবান নথিপত্র বিক্রির ব্যবসা চালিয়ে আসছে চক্রটি। দীর্ঘ দিন ধরে এত বড় অন্যায় চললেও চক্রটির দৌরাত্ম ও লাগাম টানার কেউ নেই। যাদের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তারাও টাকার কাছে ভলিউমের ছেড়া পাতার মত বিক্রি হয়ে গেছেন। ফলে রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুম জুড়ে চলছে চক্রের অবাধ আধিপত্য। বছরের পর বছর ধরে চলছে তাদের এই অপরাধের রাজত্ব।
আর এই রেকর্ডপত্র বিক্রি হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন জমির আসল মালিকরা। দখল, উচ্ছেদসহ বিভিন্ন ধরণের মামলার ক্ষেত্রে তাদের ভুগতে হচ্ছে বছরের পর বছর। জমির প্রকৃত মালিক হয়েও তারা মালিকানা প্রমাণ করতে পারছেন না। যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রকম সামাজিক সংকট। জমি নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। জমি কেনাবেচার পর ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ঘটছে সহিংসতার ঘটনায়। জমি নিয়ে মারামারি হানাহানির মত ঘটনা ঘটছে অহরহ। আর যার মূলে রয়েছে এই পাতা ছেড়া চক্র।
মিলন-সাইফুল চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে রেকর্ড রুম সংশ্লিষ্ট কাজে এক দায়িত্বপ্রাপ্তও। জেলা রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে আশারফ হোসেন নামে একজনকে ওই পদে বসিয়েছে নকলনবিশ সাইফুল ইসলাম। সংরক্ষিত কক্ষ রেকর্ড রুমের কোন দায়িত্ব দেয়ার এখতিয়ার জেলা রেজিস্ট্রারের। সাইফুল ইসলামের সাথে ডিআর অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রারের সখ্যতা থাকায় সহজে কাজটি করিয়ে নিয়েছেন। আর এতে করে তাদের পাতা ছেড়া, তফশিল খুলে অন্য কাগজ ঢুকিয়ে দেয়া আরো সহজ হয়ে গেছে। রেকর্ড রুমের নথি পাচারে আশরাফ হোসেন চক্রটিকে সহায়তা দিয়ে আসছে।
রেজিস্ট্রি অফিসের ভলিউম বইয়ের পাতা ছেড়ার ঘটনার তথ্যদাতারা জানিয়েছেন, দলিল নম্বর ৮৮৯। ৬৩ নম্বর ভলিউম বুকের ৫ থেকে ১৫ নম্বর পাতা ছিড়ে গায়েব করে দিয়েছে চক্রটি। এছাড়াও এর আগে বেশ কয়েক বছর আগে সাইফুল ইসলাম ভলিউম বই থেকে ৫৮৬৮ নম্বর দলিলের পাতা ছিড়ে নেয়। ১৯৯৩ সালে কেশবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ওই দলিলটির নিবন্ধন হয়। জমির মালিক নকল তুলতে গিয়ে জানতে পারেন ভলিউম বইতে তার জমির কোন রেকর্ড সংরক্ষিত নেই।
আরো পড়ুন: স্লোগানের নামে ভেল্কিবাজি
এছাড়াও ১৯৭৬ সালে যশোর সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১৬২৮৬ নম্বর দলিল সম্পাদিত হয়। যার ভলিউম নম্বর ২০৩। পাতা নম্বর ১১৫, ১১৬ ও ১১৭। ওই দলিলের জমির মালিক মাগুরার শালিখা উপজেলার দুদু মিয়া। ১১৫, ১১৬ ও ১১৭ নম্বর পাতা থেকে তার জমির রেকর্ডপত্র গায়েব হয়ে যায়। শুধু তাই নয় সেখানে সেটে দেয়া হয় ঢাকার এক ব্যক্তির জমির কাগজপত্রও। এছাড়া ১৯৮০ সালে রেজিস্ট্রি হওয়া ৫৮৫ নম্বর দলিল। ভলিউম নম্বর ৪। ওই দলিলের রেকর্ডও ভলিউম বই থেকে ছিড়ে ফেলা হয়। ২২৭, ২২৮, ২২৯ ও ২৩০ নম্বর পাতা ছিড়ে ফেলে চক্রটি।
২০১৩ সালেও একবার ভলিউম বইয়ের ভলিউম বুক থেকে মূল দলিল সরিয়ে ফেলে সাইফুল-মিলন চক্র। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল ৪৩৭৯ নম্বরের দলিলটি রেজিস্ট্রি হয়। নকল তোলার নাম করে মূল দলিল ছিড়ে নিয়ে তফসিল লেখা পাতা খুলে নিয়ে নতুন পাতা ঢুকিয়ে দেয়। ঘটনা জানাজানির পর ফের ভুতের আছর শুরু হয়। একবছর পর রেকড রুম থেকে চুরি যাওয়া ওই দলিলের পাতা যথাস্থানে পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পর তৎকালীন সদর সাব-রেজিস্ট্রারকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্তে প্রমাণিত হয় জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের নকলনবিস সাইফুল ইসলাম দলিলের পাতা চুরির সাথে জড়িত। তদন্ত রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলামকে তার পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেন। এ চক্রটির দুর্নীতির খতিয়ান অনেক লম্বা। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
১৯৯৯ সালে ঝিকরগাছা রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত একটি দলিলের নম্বর ৭১৯৪। ৯৬ নম্বর ভলিউমে ৩০ থেকে ৩৩ পাতায় এ দলিলের নকল লেখো ছিল। কিন্তুু দলিলের দাগ নম্বর ৯১৯৬ পরিবর্তন করে ৯৯৯৫ করা হয়। এ পরিবর্তনের সাথে জড়িত নকলনবীশ সাজ্জাদ হোসেন ও লিটন বিশ^াসকে সাসপেন্ড করা হলেও রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট তা প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৭৪ সাওেল সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদিত ১৬১০০ ও ১৬০৩৫ নম্বর দলিল দুটির নকল ২২৮ নম্বর ভলিউমে লেখা হয়। কিন্তু এ ভলিউমের পাতা কেটে অন্য পাতা জোড়া হয়েছে। মাগুরার শ্রীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৬৩ সালের ৯ নম্বর ভলিউমের ২২১ পাতার পর সব পাতা কেটে নেয়া হয়েছে। ১৯৫৯ সালে যশোর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৩৪৯২ নম্বর রেজিস্ট্রি হয়েছিল। এ দলিলটির নকল লেখা ছিল ৩১ নম্বর ভলিউমের ২৭৯-২৮০ পাতায়। কিন্তু পাতা দুটি ওই ভলিউমে নেই।
তফসিল লেখা পাতায় জমির বিবরণ দাগ, খতিয়ান, জমির পরিমাণসহ বিভিন্ন বিবরণী উল্লেখ থাকে। কিন্তু ওই জমির রেকর্ডের স্থলে যেসব কাগজপত্র ঢোকানো হয়েছিল সেসব দাগ নম্বরের জমি আদতে নেই। এই বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে তদন্ত হয়। তৎকালীন নকলনবিশ সাইফুল ইসলাম তদন্তে দোষি প্রমাণীত হয় ও তাকে সাময়িক অব্যাহতিও দেয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে ওপর মহলের সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকা ঢেলে পুনরায় স্বপদে ফিরেছে পাতা ছেড়া চক্রের হোতা। কিছুদিন বিরতি দিয়ে ফের আগের মূর্তি ধারণ করেছে। রেজিস্ট্রি অফিসে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকারি রেটে নয় মিলন-সাইফুল সিন্ডিকেটের ধার্য রেটে রেজিস্ট্রি অফিসে জমিজমার নিবন্ধন চলছে। সেই সাথে যশোরসহ ১৯ জেলার গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও নথির সংরক্ষণের মহাফেজখানাটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীন শহর হওয়ায় এই জেলাসহ ১৯ জেলার জমির দলিলসহ অন্যান্য ডকুমেন্টস যশোর জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত আছে।
আরো পড়ুন:
স্লোগানের নামে ভেল্কিবাজি
জিরো থেকে হিরো মিলন-সাইফুল