লাবুয়াল হক রিপন: যশোর শহরের ষষ্ঠীতলার বুনোপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে নকল ফেনসিডিল তৈরি করে আসছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
এই মাদক ব্যবসায়ীরা কোডিন ফসফেট নামের পাউডার, চিনির ঘন সিরা, স্পিরিট ও কর্পূরের মতো একটি পদার্থ দিয়ে ঘরে বসেই নকল ফেনসিডিল তৈরি ও বোতলজাত করে তা মাদক মার্কেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহুদিন ধরে এ চক্রটি কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এদের যোগসাজসে নকল এ ফেনসিডিল দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত সোর্সরা নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে বলেও গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে। এসব তথ্য পাওয়ার পর রোববার বিকেলে যশোর শহরের ষষ্ঠীতলার বুনোপাড়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই সটকে পড়ে মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শহরের ষষ্ঠীতলার বুনোপাড়ার মৃত শফি মিয়ার ছেলে হাফিজুর রহমান মরা ছিলেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মরা। তার মৃত্যুর পর মরার স্ত্রী রেখা বেগম আরেক যুবককে বিয়ে করে ওই বাড়িতেই বসবাস করছেন। কিন্তু রেখা স্বামীর ‘উত্তসূরি’ হিসেবে দেদারছে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের কারবার। একই সাথে রেখা নিজেই ফেনসিডিল তৈরি করে বিক্রি করছেন এবং বাইরে সাপ্লাইও দিচ্ছেন।
এছাড়া মরার ছোট ভাই রবিউল ইসলাম, রবিউলের স্ত্রী আকলিমা বেগম, মেয়ে এরিনা খাতুন, ভাই রফিকুল ইসলাম চায়না এবং আরেক ভাই মৃত সাইফুল ইসলামের স্ত্রী হাসিনা বেগমও একই সাথে ফেনসিডিল তৈরি এবং বিক্রি করে আসছেন। তবে রফিকুল ইসলাম চায়না ও হাসিনা শুধু ফেনসিডিলই নয়, তারা দেদারছে ইয়াবার কারবারও করছেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। একই বাড়িতে এতগুলো লোকে মাদকের কারবার করায় বাইরে থেকে কেউ ওই এলাকা দিয়ে চলাফেরাও করতে পারছেনা। বুনোপাড়ার রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করার সময় মাত্র কয়েকদিনে সবুজ, আজাদ, নিখিল, নার্গিস, সৈয়দ, তুহিন, হাচিনা, আনু, শিউলি, জোৎস্না, শহিদুল ইসলাম, হামু, সুফি, পলাশ, নান্টুসহ অনেককেই আটক করিয়ে দিয়েছে ওই সিন্ডিকেট। তবে আটক করা অধিকাংশ লোকের কাছ থেকে ৮ বোতল করে ফেনসিডিল উদ্ধার দেখানো হয়েছে। ফলে ওই রাস্তা দিয়ে এখন মানুষ চলাফেরা করতেও ভয় পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, ৫০ গ্রাম কোডিন ফসফেট পাউডার দিয়ে তৈরি করা যায় প্রায় ৫০০ বোতল ফেনসিডিল। খয়েরি রঙের এই পাউডার হেরোইনের চেয়েও দামি। এক চা-চামচ পাউডার দিয়ে ১০ লিটার ফেনসিডিল তৈরি করা যায়।
এই পাউডারের সাথে অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে চিনির ঘন সিরা, স্পিরিট ও কর্পূরের মতো একটি পদার্থ যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।
অপরদিকে রেল লাইন পার হলেই রায়পাড়ায় রয়েছে মুরগি রহিম ওরফে সোর্স রহিম। দীর্ঘদিন ধরে সোর্স বিভিন্ন বাহিনী সোর্স পরিচয় দিয়ে আসছেন। সেকারণে বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে আটক হওয়া কারবারিদের কাছ থেকে সোর্সের মুজুরি হিসেবে পাওয়া ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজা তারা নিজেরাই বিক্রি করে থাকে। এর পাশাপাশি সোর্স রহিম মাদকের হাট নামে খ্যাত চাঁচড়া রায়পাড়ার অন্য সকল মাদক কারবারিদের কাছ থেকে বিভিন্ন বাহিনীর নামে মাসোয়ারা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মুরগি রহিম তার স্ত্রী দুলারী দীর্ঘদিন ধরে মাদকের কারবার করলেও বিভিন্ন বাহিনীর সোর্স হিসেবে অন্তত তিন ডজন মামলার সাক্ষী হয়েছে। ওই মামলাগুলো পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকেরাই করেছে।
কথিত আরেকজন সোর্স রায়পাড়ার ইসরাইল ড্রাইভারের ছেলে সজল। সোর্স পরিচয়েই বিভিন্ন কারবারিদের কাছ থেকে মাদকের চালান ছিনিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে পঙ্গু হাসপাতালে রোগীর স্বজন ঝিনাইদহের মফিজুর রহমানকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সেকারণে বর্তমানে সজল পলাতক রয়েছে।
এই এলাকার বড় জয়নাল নামে আরেক সোর্স রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সোর্সের কাজে নিজেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে গাড়ি তল্লাশি করে যাত্রীদের টাকা ও মালামাল নিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর নিজে সোর্স বলেই তার বোন শেফালি ও ভগ্নিপতি জাফর মাদকের কারবার করেন।
একই এলাকার আরেক সোর্স পরিচয়ধারী হোসেন মরা ও তার স্ত্রী আসমা বেগম ও এলাকার বড় মাদকের কারবারি। দীর্ঘদিন ধরে এই কারবার করে আসলেও তার বিরুদ্ধে তেমন কোন মামলা হয়নি বললেই চলে। কারণ হোসেন মরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে নিতে জানেন।
নকল ফেনসিডিল তৈরি এবং কারবারিদের আটকের জন্য রোববার বিকেলে কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি টিম ওই এলাকায় অভিযানে যায়। কিন্তু কাউকে আটক করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেছেন, মাদক কারবারি যেই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।