জেমস রহিম রানা ও মনিরুজ্জামান মনি: আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে কাজ করছেন স্বতন্ত্রের মোড়কে থাকা বিদ্রোহী প্রার্থীরা। আর সেটাই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের। যে কারণে বিদ্রোহী আখ্যায়িত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে উঠতে দিতে নারাজ দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা। সর্বত্র পাল্লা দিয়ে চলছে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, পোস্টার ছেড়াসহ প্রচার মাইক-গাড়ি ভাঙচুর। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীরা। ফলে রিটার্নিং অফিসারের অফিসে জমা হচ্ছে অভিযোগের পাহাড়।
দেয়াড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী লিয়াকত আলীকে অন্য প্রার্থীর পাশাপাশি লড়তে হবে ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের সঙ্গে। তিনি আনারস প্রতীকে ভোট পাওয়ার জন্য সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে চষে বেড়াচ্ছেন। গতকাল তিনি নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী অফিস ভাংচুরসহ পোষ্টার ছেড়ার এন্তার অভিযোগ করে বলেছেন, আমাদের ইউনিয়নে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চলছে। নির্বাচনী প্রচারণায় তেমন কোন বাধা বিপত্তি নেই বললেই চলে। তবে কিছু কিছু এলাকায় রাতের আঁধারে আমার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমার কর্মী সমর্থকরা সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা করে যাচ্ছে। তার অভিযোগ গত রোববার নৌকার প্রার্থীর লোকেরাই তার অফিস ভাঙচুর করেছে।
এদিকে, নৌকার প্রার্থী শওকত আলী তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তোলা অভিযোগের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একজন কলেজ শিক্ষক, আমি চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। তবে আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। আমার লোকজন কোনভাবেই অফিস ভাঙচুর এবং পোস্টার ছেড়েনি বরং এগুলো আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে বলে আমি মনে করি। আমি আমার ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি বিজয় লাভ করবোই।
তিনি আরও বলেন পোস্টার ছিড়ে বা অফিস ভাঙচুর করে মানুষের মন জয় করা সম্ভব নয়। তাই আমি দলীয় প্রতীক পাওয়ার পরও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছি।
স্বতন্ত্র মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী মাসুদ রানা জানান, যদি নিরপেক্ষ ভোট হয় তাহলে আমি নির্বাচনে বিজয়ী লাভ করবো। তবে আমি এখনো নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণায় এখনো কোন বাধাগ্রস্থ হইনি ।
এখানে আরও রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা জিয়াউল হক (ঘোড়া) ও ইসলামী আন্দোলনের আব্দুল্লাহ (হাতপাখা)।
এদিকে, আরবপুর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মীর আরশাদ আলী রহমানের বিপরীতে স্বতন্ত্রের মোড়কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিন জন বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ নেতা। তারা হলেন সদ্য বহিষ্কৃত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খোকন (চশমা), ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল ইসলাম (ঘোড়া) ও ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক খন্দকার ফারুক আহমেদ (মোটরসাইকেল)। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী কাশেম (টেবিল ফ্যান), সামসুর রহমান (আনারস), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান (হাতপাখা) ও জাকের পার্টির গাজী রফিকুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।
এই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রয়েছে এন্তার অভিযোগ, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মীর আরশাদ আলী রহমানের বিরূদ্ধে। অভিযোগকারীদের বড় অংশে রয়েছেন বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী আসাদুজ্জামান খোকন বলেন, আমি চশমা প্রতীক নিয়ে প্রচার প্রচারণা করে আসছি। শনিবার রাতে নৌকার কর্মী মিঠু ও গোলাপ আমার কদমতলাস্থ নির্বাচনী প্রধান কার্যালয় ভাঙচুর করে এবং বলে যায় নৌকা প্রতীকের অফিস ছাড়া আর কোন অফিস থাকবে না। এ ব্যাপারে রোববার সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের এবং বিকেলে কদমতলায় প্রতিবাদ সভাও করেন তিনি। তার কর্মী সমর্থকরা নৌকা প্রতীকের কর্মী সমর্থকদের হুমকি ধামকি ও মারপিটের কারণে অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। প্রচার প্রচারণা এখন অনেকটাই নিরবে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রশাসনের অসহযোগিতামূলক আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেন বর্তমান পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়াও চশমা প্রতীকের কর্মীদের মারধর, প্রচার মাইক ভাঙচুর ও মহিলা কর্মীদের শ্লীলতাহানীর অভিযোগ করে সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচন পূর্ববর্তী পরিবেশ শান্ত রাখতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। আসাদুজ্জামান খোকনের অভিযোগ, গত রোববার নৌকা প্রতীকের লোকজন আমাদের পোস্টার এবং অফিস ভাঙচুর করেছে। এ বিষয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনারের অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন। পুলিশ প্রশাসনের কাছেও তিনি এ অভিযোগের কথা বলেছেন। এরপর দারোগা আসলেও তিনি বলেছেন নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে আমাদের কাছে নোটিশ গেলে আমরা এবিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। তিনি আরো বলেন, আমাদের নির্বাচনী অফিস, পোস্টার এবং বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাইকের মেমোরি পর্যন্ত খুলে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, রোববার সন্ধ্যা রাতে জামতলাস্থ নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ের ভিতরে নৌকার কর্মী মিঠু, গোলাপ, শরীফ, সাগর ও বুধোর নেতৃত্বে রফিকুল ইসলাম নামে ঘোড়া প্রতীকের এক কর্মীকে পিটিয়ে আহত করে। নির্বাচনী অফিসে ঢুকে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের ধাক্কাধাক্কি করে অফিস থেকে বের করে দিয়ে অফিসের গেট বন্ধ করে দেয় এবং ব্যানার, পোষ্টার ছিড়ে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার হুমকি প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন। কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট না দিলে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই বলেও ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন তারা। রোববার সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা থেকে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা ঘোড়ার প্রচার মাইক ও সেট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নূরুল ইসলাম।
মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী খন্দকার ফারুক আহমেদ বাবু অভিযোগ করেন, ২০ ডিসেম্বর তার উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। তিনি এখনো মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরছেন। এ ঘটনায় মামলা নেয়নি পুলিশ। তার কর্মী সমর্থকরা নৌকা প্রতীকের কর্মী সমর্থকদের হুমকি ধামকি ও মারপিটের কারণে অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। প্রচার প্রচারণা এখন অনেকটাই নিরবে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রশাসনের অসহযোগিতামূলক আচরণের কথা উল্ল্যেখ করে বলেন বর্তমান পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
এই ইউনিয়নের সকল প্রার্থীরাই বলছেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই। তবে তারা ব্যক্তি হিসেবে মীর আরশাদ আলীকে ভোট না দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভোটারদের কাছে।
টেবিল ফ্যান প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা কাজী কাসেম মুঠোফোনে বলেন, একদল সন্ত্রাসী বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছে। শনিবার রাতে একদল দুর্বৃত্ত আমার বাড়িতে এসে আমার বৃদ্ধ মাকে হুমকি ধামকি দিয়ে গেছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে আমি হতাশ না। আমার স্লোগান সাম্য সম্প্রীতি এবং সমাজিক ন্যায় বিচার। এই স্লোগানের উপর আমি নির্বাচনের আগে ও পরে চলতে চাই। ইউপি নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে যতটুকু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসন এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।
আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা সামসুর রহমান বলেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের হুমকি ধামকিতে আমার কর্মীরা ঘরে বসে গেছে। শনিবার রাতে একদল সন্ত্রাসী আমাকে বলে গেছে ভাল চাইলে নির্বাচন থেকে সরে যাও। তারা আমার পোষ্টার কেটে নামিয়ে দিয়েছে, মাইক ভাংচুর করেছে। বর্তমানে আমার প্রচার প্রচারণা বন্ধ রেখেছি। যদি নিরেপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মীর আরশাদ আলী রহমান বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ মিথ্যা নয়। আমাকে কলুষিত করার জন্য তৃতীয় পক্ষ দলের ভেতর থেকেই একটি পক্ষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে, আর দ্বায়ভার নিতে হচ্ছে নৌকার।
মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থীর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথম দিনেই তিনি আমাদের উপর দোষ চাপিয়ে দিলেন। তিনি আক্রান্ত হবার পর আমি তাকে দেখতেও গিয়েছি। চশমার অফিসে কি ঘটেছে আমি সঠিক জানিও না। কিন্তু দ্বায়ভার আমার উপর চাপানো হচ্ছে, সেটার দ্বায়ভার আমি নিবো না। কারণ আমি এসকল কর্মকান্ডে বিশ্বাস করিনা। আমি কোন সন্ত্রাসীও লালন করিনা।
সকল প্রার্থী ও ভোটারদের উদ্দেশ্যে মীর আরশাদ আলী রহমান বলেন, সকল ভোটার যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে আমার পক্ষ থেকে আমি সে ব্যবস্থা করবো।