পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
জনবল অভাবে তদারকির ব্যবস্থা নেই
জেমস রহিম রানা: যশোরের অধিকাংশ হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার অযোগ্য পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে । এর ফলে মানুষ ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। শহরের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হোটেল রেস্তোরাঁসহ ফাস্টফুডের দোকান থেকেও খাবার অযোগ্য এই পানি পান করছে মানুষ। এছাড়া খোলা, পচাবাসি খাবার তো নিত্য নৈমিত্যিক ব্যাপার। দীর্ঘদিন যাবত পৌরসভায় সেনেটারি ইন্সপেক্টর না থাকায় হচ্ছে না তদারকি।
যশোর শহরে প্রায় ৩ শতাধিক চায়ের দোকানসহ ৫ শতাধিক হোটেল রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড শপ রয়েছে। যশোর পৌরসভা থেকে ব্যবসায়িক অনুমোদন (ট্রেড লাইসেন্স) নিয়েছে মাত্র ১৬৯ টি দোকান। এর মধ্যে হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে ৯৫টি, ফাস্ট ফুডের দোকান ৪৭ টি ও চায়ের দোকান ২৭ টি।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রিক্সা চালক আবুল কালাম জানান, তিনি চারদিন আগে শহরের এমএম কলেজের দক্ষিণ পাশের খড়কি রোডের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খান। এর পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে তিনি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগি হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
একই ওয়ার্ডে ভর্তি সামসুর রহমান জানান, তিনি একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। প্রতিদিন নিয়মিত হোটেলেই খেয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। শুক্রবার দুপুরে তিনি খাবার খান শহরতলীর ধর্মতলা মোড়ের একটি হোটেলে। তারপর থেকে আমাশয়সহ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, সারাদিন শহরের মধ্যে অবস্থান করার কারণে অধিকাংশ সময় হোটেলে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার খাওয়া হয়। কিছু কিছু হোটেলে টিউবওয়েল বসানো থাকলেও পানি দেয়া হয় সাপ্লাই লাইন থেকে। যে ড্রামে পানি ভরে রাখা হয় তাও মাসের পর মাস পরিস্কার করা হয় না। রান্নাবান্না করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এ ব্যাপারে অনেকবার অভিযোগ করেও কোন ফল পাওয়া যায় না। অগত্যা এই নোংরা খাবার খেতে হয়।
ধর্মতলার সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারির মালিক উত্তম ঘোষ জানান, তিনি পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সাবমার্সিবল মোটর বসিয়ে সেই পানি সব কাজে ব্যবহার করছেন। যদিও এটি ব্যয়বহুল তারপরও মানুষের রোগব্যাধির কথা চিন্তা করেই তিনি এই ব্যবস্থা করেছেন।
ওয়াবদা গ্যারেজ মোড়ের লিমনের হোটেলে বাইরে একটি চাপকল বসানো থাকলেও সেখানে খাওয়ানো হয় সাপ্লাইয়ের পানি। তার কর্মচারী দাবি করেন অনেক সময় টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় সাপ্লাইয়ের পানি দিতে হয়।
জেনারেল হাসপাতালের সামনের ভৈরব হোটেলে দেয়া হয় ট্যাংকিতে রক্ষিত খাবার পানি। এই পানি সাবমার্সিবল মোটরে তোলা হলেও ট্যাংকি পরিস্কার করা হয়না মাসের পর মাস। পানিতে পোকাসহ স্যাদলা পর্যন্ত নেমে আসে। কোন কোন সময় ট্যাপের মুখে কাপড়ের ছাকনি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
নিউ ভৈরব হোটেল মালিক বাবু মোল্লা জানান, প্রতিমাসে কিছু মানুষকে টাকা দিয়েই সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়। অনেককে ফ্রি খাবার দিতে হয়। কোন কোন সময় সাংবাদিক পরিচয়েও সুযোগ সুবিধা ভোগ করে অনেকে।
দড়াটানার ফিরোজের হোটেলে পানি সরবরাহ করেন রেল গেটের রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ ৮ বছর শহরের বিভিন্ন হোটেল ও চায়ের দোকানে জারে করে পানি দিয়ে থাকি। অধিকাংশ দোকানদার টাকা বাঁচানোর জন্য অল্প পরিমাণ পানি নিয়ে বাদবাকি সাপ্লাইয়ের পানি দিয়ে দিন পার করে।
একইভাবে পানি সরবরাহকারি সাড়াপোল গ্রামের শহিদুল ইসলাম জানান, একটি চায়ের দোকোনে দিনে কমপক্ষে ১০ জার পানির প্রয়োজন হলেও তার কাছ থেকে নেয়া হয় ৪ থেকে ৬ জার পানি। বাকি পানি তারা নিজেরা সাপ্লাই লাইন থেকে নিয়ে ব্যবহার করে। এক জার পানির জন্য তিনি দোকানের মালিক থেকে নিয়ে থাকেন ১০ টাকা। সামান্য টাকা বাঁচাতে গিয়ে দোকানীরা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে এটা অন্যায়।
মণিরামপুর থেকে এসে হোটেলে পানি দেন আজগর আলী। তিনি বলেন, শহরের কোন হোটেল বা ফাস্টফুডের দোকানদার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না তিনি শতভাগ বিশুদ্ধ পানি পান করান। কোন কোন হোটেলের ভিতরে টিউবওয়েল বসানো থাকলেও তা আইওয়াস। সেনেটারি বিভাগের কোন তদারকি না থাকার সুযোগে ব্যবসায়ীরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এর সুরাহা হওয়া দরকার।
ষষ্টিতলার পানি বিক্রেতা খলিল জানান, সাপ্লাইয়ের মাধ্যমে যে পানি আসে তাতে কেঁচো পর্যন্ত পাওয়া যায়। তারপরও হোটেল মালিকসহ চায়ের দোকানদাররা টাকা বাঁচাতে সেই পানি কাপড়ে ছেকে খরিদ্দারদের খাইয়ে থাকে। যা সম্পূর্ণ অমানবিক।
সাড়াপোলের আমিনুর রহমান বলেন, আমি ৬ বছর যাবত শহরের কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকান ও বিরিয়ানী হাউসে পানি দিয়ে আসছি। যেখানে ২০-২৫ জার পানির দরকার হয় সেখানে আমার কাছ থেকে নেয়া হয় ৪-৫ জার। বাকি পানি তারা কোথায় পায় তা বলতে পারি না। কিন্তু আজও কোন দোকানদারকে বলতে শুনিনি তিনি পানির সংকটে পড়েছেন। আইনগত কোন বিধিনিষেধ আছে কি না তা তিনি জানেন না।
যশোর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত সেনিটারি ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন যাবত সেনিটারি ইন্সপেক্টরের পদ শূন্য রয়েছে। অনেকবার তাগাদা দেয়া সত্বেও কোন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। জনবল কম থাকায় নিয়মিত তদারকি হয় না । তাছাড়া আমি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নই। যে কারণে তদন্ত করাও সম্ভব হয় না।
পৌর সভার লাইসেন্স ইন্সপেক্টর মেজবাহ উদ্দিন জানান, যশোর পৌর এলাকায় প্রায় ৩ শতাধিক চায়ের দোকানসহ ৫ শতাধিক হোটেল রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড ও টি স্টল রয়েছে। যার মধ্যে যশোর পৌরসভা থেকে ব্যবসায়িক অনুমোদন (ট্রেড লাইসেন্স) নিয়েছে মাত্র ১৬৯ টি দোকানের। এর মধ্যে হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে ৯৫টি, ফার্স্ট ফুডের দোকান ৪৭ টি ও চায়ের দোকান ২৭ টি। ইতোপূর্বে অবৈধ ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে এবং দোকানদারদের জরিমানাসহ সিলগালা করা হয়েছে। তারপরও তারা আবার সেই অবৈধ ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে পৌরসভায় জনবল কম থাকায় অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।