* ২ হাজার টাকার ইলিশ ১৫শতে রফতানি
* দাম কমার অপেক্ষার মধ্যে ভারতে রফতানি
* প্রথম চালানে বেনাপোল দিয়ে গেছে ৩৭ টন ৪৬০ কেজি
নিজস্ব প্রতিবেদক
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাসুদ পারভেজ যশোর শহরের বড় বাজারে ইলিশ মাছ কেনার জন্য ঘুরছিলেন। এসময় এ বছর এখনো ইলিশ মাছ না খাওয়ার আক্ষেপের কথা বলছিলেন এ প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, ‘এ বছর এখনো ইলিশ খেতে পারিনি। বাজারে চড়া দাম। ভেবেছিলাম দাম কমবে। এর মধ্যে ভারতে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন আর খাওয়ার কোনো আশাই থাকলো না।’
অপরদিকে শহরের পুরাতন চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজারে কথা হয় আরেক ক্রেতা রেখা খাতুনের সঙ্গে। ইলিশ মাছের দোকানের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন এ গৃহবধূ। মাছ কিনবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছর শুধু নয়, শহরে আসার পর কখনোই ইলিশ মাছ কিনতে পারিনি। ছেলেমেয়ে খুব খেতে চায়। কিন্তু কিনতে পারি না, দামের কারণে সাহসে কুলায় না। ইলিশ মাছ খাবো এই সামর্থ্য আমাদের এখনো হয়নি ভাই।’
অতিরিক্ত দামের কারণে নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও ইলিশ মাছ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকার ওপরে। ঠিক এমন পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন দুর্গাপূজায় উপলক্ষে প্রথম চালানে ৩৭ টন ৪৬০ কেজি ইলিশ গেলো ভারতে। রফতানি করা ওই ইলিশের দাম পড়ছে ১ হাজার ৫৩৩ টাকা। বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৬টি ট্রাকে এই প্রথম চালান ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেনাপোল বন্দর পরিচালক শামীম হোসেন।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ভারতের কলকাতার পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রথম চালানের ইলিশ আমদানি করেছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-ন্যশনাল ট্রেডিং, এফএনএস ফিশ, জয় শান্তসী, মা ইন্টারন্যাশনাল ও আর জে ইন্টারন্যাশনাল।
অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে ৬টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রথম চালানের ৩৭ টন ৪৬০ কেজি ইলিশ পাঠিয়েছে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-সততা ফিশ, স্বর্ণালি এন্টারপ্রাইজ, তানিশা এন্টারপ্রাইজ, বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ ও লাকী ট্রেডিং।
আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ভারতে মোট এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ টন, ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ টন করে ৭৫০ টন, ৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৪০ টন করে ৩৬০ টন এবং দুটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ টন করে ৪০ টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বেনাপোল মৎস্য কোয়ারেন্টাইন অফিসার সজীব সাহা জানান, এবার আসন্ন দুর্গা পূজায় ৩৭টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ১২০০ টন ইলিশ ভারতে রফতানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তারই আলোকে মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুমোদন করা ইলিশ রফতানি শেষ করতে হবে। প্রতি কেজি ইলিশের রফতানি মূল্য ১২ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫০০ টাকা। প্রতিটি ইলিশের ওজন প্রায় এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজির মধ্যে।
ইলিশের এ মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই ইলিশের দাম চড়া। রপ্তানির সিদ্ধান্ত বাজারে দাম আরও উসকে দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্নচিত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলোতে। সেখানকার বাজারগুলোতে ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। তারপরও প্রতি বছরের মতো সে দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবিতে ইলিশ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার প্রতি কেজি ইলিশের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ১২ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার বা ১৫২৫ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) নির্ধারণ করেছে। তবে এ দামে ঢাকার বাজারে এক কেজি সাইজের একটি ইলিশ পাওয়া যায় না।
বুধবার বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম দুই হাজার টাকা। তার চেয়ে বড় হলে তিন হাজার টাকারও বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতারা
খুচরা বাজারেও সাগর ও নদীর মাছভেদে কেজি সাইজের কম বা ৮শ গ্রাম হলে ১৮শ, ৬শ গ্রামের কাছাকাছি ১৪শ-১৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ৪শ গ্রাম বা তার চেয়ে কম ওজনের ইলিশের কেজিও হাজার টাকার ওপরে। ফলে ইলিশের কেজিপ্রতি গড় দাম ধরা হলে সেটা প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি হবে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এবার ইলিশের দাম ৯শ থেকে ২২শ টাকা, যা গত বছর ছিল ৮শ থেকে ১৬শ টাকার মধ্যে।
এদিকে ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ভরা মৌসুমে ২০১৪ সালে ৫০০-১০০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের গড় দাম ছিল ৫০৫ টাকা, যা এখন বাজারে কয়েকগুণ বেশি।
পাঁচ বছর ধরে ভারতে যাচ্ছে ইলিশ :
২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতীয় রপ্তানি নীতিতে (২০১৫-১৮) ইলিশ মাছ শর্তসাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় রাখা হয়। তবে ইলিশ রপ্তানির প্রথম অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। সেবার ইলিশের তিনটি চালান ভারতে পাঠানো হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় এক হাজার ৬৯৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৩৯১ টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন।