নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোরের বকচর জোড়া মন্দির এলাকার হাফিজুর রহমানের স্ত্রী মনিরা বেগম বিভিন্ন মেসে রান্না করে জীবন চালান। তার নামে সাত লাখ টাকার চেক ডিজঅনার মামলা! একই এলাকার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তরিকুল ইসলামের স্ত্রী রাজিয়া বেগমের নামে মামলাটি আট লাখ টাকার। ব্যবসায়ী কামরুজ্জামানের স্ত্রী রেশমা সুলতানার নামে দুই চেকে ১০ লাখ টাকার মামলা ও লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এভাবেই যশোরের বকচর জোড়া মন্দির এলাকার ছয় হতদরিদ্র নারীর বিরুদ্ধে ৪০ লক্ষাধিক টাকার চেক ডিজঅনার মামলা হয়েছে। গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে মামলাগুলো করেছেন রফিকুল ইসলাম জনি ও জাহানারা বেগম পিয়ালী নামের দুই ‘প্রতারক’। স্বল্প সুদে এনজিও ঋণের প্রলোভন দিয়ে তাদের কাছ থেকে ফাঁকা চেক নিয়েছেন জনি ও পিয়ালী। এখন এই প্রতারণার জাল থেকে বাঁচতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন অসহায় ওই নারীরা।
‘প্রতারক’ রফিকুল ইসলাম জনি যশোর সদর উপজেলার ডাকাতিয়া গ্রামের মো. আবু সাঈদ হাসানের ছেলে। তার সহযোগী জাহানারা বেগম পিয়ালী যশোর সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। পিয়ালী বকচর কবরস্থান রোড এলাকায় বাড়িভাড়া নিয়ে এই নারীদের প্রতারণার জালে জড়িয়েছেন বলে তাদের অভিযোগ। জনিকে তিনি স্বামী পরিচয় দিতেন এবং ওই বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল। জনি এর আগে সদর উপজেলার শানতলা এবং পরে বকচর জোড়া মন্দির এলাকায় চাকরি ও ঋণের কথা বলে ৯০ জন নারীর কাছ থেকে ১০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়ে গাঢাকা দেন।
ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের অভিযোগ, যশোরের বকচর জোড়া মন্দির ও কবরস্থান এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ঘরভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন জাহানারা বেগম পিয়ালী। রফিকুল ইসলাম জনিকে তার স্বামী বলে পরিচয় দিতেন এবং জনি বিদেশে আছেন উল্লেখ করতেন। পিয়ালীর ভাড়া বাড়িতেই ওঠাবসা করতেন টিএমএসএস নামের একটি এনজিওর কর্মীরা। সেই সূত্র ধরে স্থানীয়দের মাঝে নতুন এনজিও খোলা ও ঋণ দেওয়ার কথা বলেন পিয়ালী।
পরে ঋণের জন্য বিভিন্ন সময়ে ওই এলাকার রেশমা সুলতানা, রাজিয়া বেগম, মনিরা বেগম, নার্গিস আক্তার লিপি ও আফরোজা আক্তার শিল্পীর কাছ থেকে ব্যাংকের ফাঁকা চেক নেন পিয়ালী। এরপর তাদের ঋণ না দিলেও ফাঁকা চেকে রেশমা সুলতানার পাঁচ লাখ, রাজিয়া বেগমের আট লাখ, মনিরা বেগমের সাত লাখ, আফরোজা আক্তার শিল্পীর ১০ লাখ এবং নার্গিস আক্তার লিপির চার লাখ টাকা বসিয়ে চেক ডিজঅনার করান।
অন্যদিকে, জনি আরেকটি ফাঁকা চেকে রেশমা সুলতানার নামে পাঁচ লাখ এবং সুমাইয়া খাতুন নামে আরেক নারীর নামে আড়াই লাখ টাকার চেক ডিজঅনার করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। সবমিলিয়ে এই ছয় নারীর নামে ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকার চেক ডিজঅনার করিয়ে মামলা ও লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন দুজন।
মুড়লি জোড়ামন্দির এলাকার কামরুজ্জামানের স্ত্রী রেশমা সুলতানা জানান, তার বাড়িতে চানাচুর কারখানা স্থাপনের কথা বলে নিচতলা ভাড়া নেন রফিকুল ইসলাম রাজ। ‘গ্রুপ আর এল কোং’ নামে চানাচুর ও প্যাকেজিং ফ্যাক্টরির অংশীদার করার কথা বলে তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ধার নেন। এছাড়া তার ভাড়াটিয়া সুমাইয়া খাতুনের ঋণের জন্য গ্যারান্টার হিসেবে তার একটি ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প নেন। এখন ওই চেকের পাতা ব্যবহার করে রাজ তার নামে পাঁচ লাখ টাকার চেক ডিজঅনার করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। আর সুমাইয়ার চেকের পাতা নিয়ে তার নামে আড়াই লাখ টাকার চেক ডিজঅনার নোটিশ দিয়েছেন। এর আগে আরেকটি চেকে পাঁচ লাখ টাকা ডিজঅনার করে মামলা করেছেন জাহানারা বেগম পিয়ালী।
আরেকটি চেকে আট লাখ টাকার মামলার শিকার রাজিয়া বেগম জানান, স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ফাঁকা চেক নিয়েছিলেন পিয়ালী। এখন সেই চেকে আট লাখ টাকার মামলা করেছেন। একই ঘটনার শিকার বিভিন্ন মেসে রান্নার কাজ করা হতদরিদ্র মনিরা বেগম। তার নামে মামলা হয়েছে সাত লাখ টাকার।
ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, এনজিও ঋণের কথা বলে ফাঁকা চেক এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০-২০ হাজার হাতিয়ে নিয়েছেন পিয়ালী ও রাজ। এরপর উল্টো চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন। ওই চেককে পুঁজি করে তারা অর্থবাণিজ্যের চেষ্টা করছেন।
এদিকে একইসঙ্গে প্রতারণার চক্র তৈরি করলেও এখন কেউ কাউকে ‘চেনেন না’ বলে দাবি করেছেন রফিকুল ইসলাম রাজ ও জাহানারা বেগম পিয়ালী।
মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহানারা বেগম পিয়ালী দাবি করেন, ওই নারীদের প্রত্যেকেই তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চেক দিয়েছেন। ধার পরিশোধ না করায় তিনি চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘ওরা কি পাগল নাকি যে টাকা না নিয়ে ফাঁকা চেক দেবে?’
অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম রাজকে তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেন। এরপর তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
রফিকুল ইসলাম রাজ দাবি করেন, রেশমা সুলতানা ও সুমাইয়া খাতুন তার কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা ধার নিয়েছেন। ওই টাকা ফেরত না দেওয়ায় তিনি চেক ডিজঅনার মামলা করেছেন।
রাজও দাবি করেন, তিনি জাহানার বেগম পিয়ালীকে চেনেন না। রেশমা সুলতানার কাছে পিয়া (পিয়ালী) নামের একজনের কথা শুনেছিলেন। তার স্বামীর নাম রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সেই রফিকুল তিনি নন।
চেক ডিজঅনার মামলার প্রতারণার ফাঁদে পড়া নারীদের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুলু জানান, ঋণের কথা বললেও এই নারীরা আসলে কোনো টাকা পাননি। উল্টো ফাঁকা চেক নিয়ে তাদেরকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
