কল্যাণ ডেস্ক
ধেয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। এর অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে পূর্বাভাসে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এরই মধ্যে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৮ নম্বর এবং মোংলায় ৪ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপ হওয়ায় বাংলাদেশ অবশ্য এ ধরনের দুর্যোগপ্রবণ এলাকাই। এর আগেই বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী বাংলাদেশের উপকূল তছনছ করে দিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের নামকরণ হতো না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে, ১৯৬০-২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩টি বড় সাইক্লোনের ঘটনার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়: ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামে আঘাত হানা এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। অসংখ্য গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি ডুবে যায়।
১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়: উরিরচরের ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত এই সাইক্লোনটির বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ১৫৪ কিলোমিটার।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়: নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২৫ কিলোমিটার।
১৯৯১ সালের ২৯-৩০ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়টি ‘শতাব্দীর প্রচণ্ড তম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। মাছধরার ট্রলার সাগরে ডুবে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে। তাঁদের হিসাব নেই। ছয় ঘণ্টা ধরে স্থলভাগে অবস্থান করে তাণ্ডব চালায় এই সাইক্লোনটি।
ঘূর্ণিঝড় সিডর: ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে যার বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার।
ঘূর্ণিঝড় আইলা: ২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান: সুপার সাইক্লোন আম্ফান বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে ২০২০ সালের ২০ মে। ২০০৭ সালের সিডরের পর থেকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি। এর আগে বঙ্গোপসাগরের মাত্র দুটি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তীব্রতার কাছাকাছি যেতে পেরেছিল। তার মধ্যে একটি আঘাত হেনেছিল ওড়িশায় (১৯৯৯ সালে), অন্যটি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে (১৯৯১ সালে)। এই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় প্রাণ হারান ১২৮ জন।
সংক্ষেপে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় : বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড়- ১৮৭৬ সালের ১লা নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি অনেকের কাছে বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ২ লাখ মানুষ, যখন ১০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে ১লা অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস এর পূর্বাভাস দেওয়া হলেও পরে তা বার্মার উপকূলে আঘাত হানে। মিয়ানমারে এর প্রভাবে বহু ক্ষতি হয়। ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে ৫-৭ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’। ২০১৬ সালের ২১ মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। ২০১৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’।