নিজস্ব প্রতিবেদক
নদীর ধারে বিশাল দুটি বট আর পাকুড় গাছ জড়াজড়ি করে উঠে গেছে। এই দুই গাছের পাশে মাথা উঁকি দিয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা গাব গাছের! এই গাছের গোড়া থেকে শুরু করে আশপাশের প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে ধলগাঁ (ধলগ্রাম) বাজার। লোকমুখে প্রচার আছে, দেড়শ বছরের অধিক সময়কাল ধরে চলে আসছে এই ধলগাঁর হাট। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগাঁ বাজার শুধু একটি বাজার নয়, এটি স্থানীয় মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ধারক। এই বাজার নিয়ে গর্ব করেন তারা। ছেলেবেলায় বাপ-দাদার সঙ্গে হাটে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেন সময় পেলেই। দেড়শ বছর ধরে চলমান এই বাজার আজও সমানভাবে বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে আছে। এই আধুনিক যুগেও হাটের দিন বেচাকেনার ধুমে হয়ে ওঠে জমজমাট।
যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি. পূর্ব-পশ্চিমে বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত ধলগ্রাম বাজার। এই বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চিত্রা নদী। বাজারের প্রধান অংশে নদীতে রয়েছে বহু পুরোনো একটি ঘাট। যেখানে ভিড়ে নৌকা, ট্রলার। এক সময় মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলার কারবারিরা এই হাটে আসতেন বজরা নৌকা নিয়ে। একেকটি নৌকায় তারা একশ থেকে পাঁচশ মন ধান বা পাট খরিদ করে নিয়ে যেতেন। নদীর ঘাটে বাঁধা থাকত শয়ে শয়ে নৌকা।
স্থানীয় লোকজন জানান, শনি ও বুধবার-এই ২ দিন ধলগাঁর হাট। অন্যদিনগুলোতে নিয়মিত বাজার বসে। বাঘারপাড়া উপজেলা শহর থেকেও এই হাটে লোকজন বাজার করতে আসেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এই হাটে কথা হয় নদীর ওপারের বাসিন্দা কৃষক শহিদুল ইসলামের (৭২) সঙ্গে। ধলগাঁ হাটের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে আব্বার ছিকেবাঁকের (বাঁশের তৈরি, দুইপাশে ঝুড়িতে ভরা মালামাল কাঁধে ঝুলিয়ে বহন করা হয়) ডালায় বসে হাটে আসতাম। ধান বিক্রি করে আব্বা বাজার-সদাই করতেন। আর আমাকে কিনে দিতেন রসগোল্লা, জিলাপি, বাতাসা। কখনো-সখনো সেই সময়কার বিখ্যাত নিমতলার ভাজা কিনে দিতেন শালপাতায় মোড়া। তিনি বলেন, বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি এই হাটে অনেক দূর থেকে লোকজন আসতেন। তারা মূলত এখানকার পাট ও ধান কেনার জন্য বড় বড় নৌকা নিয়ে ঘাটে দু-একদিন থাকতেন। দশপাখিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোসলেম মুন্সী বাবার সঙ্গে ৮-১০ বছর বয়স থেকেই আসতেন হাটে। সেদিনও এলেন টুকটাক বাজার করতে। এই বাজারের সবাই তাকে চেনেন। ভ্যানে উঠিয়ে দেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, খুব ছোটকাল থেকে দেখেছি, এখানকার হাটে বাইরের জেলার লোক আসতেন পাট, ধান আর গুড় কিনতে। ঘাটে দেখতাম শয়ে শয়ে নৌকা বাঁধা। সেই সময় অবশ্য এত দোকানঘর ছিল না। কথা হয় আন্দোলবাড়িয়া গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব পুলিন বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানান, বাবা-ঠাকুরদারাও এই বাজারে আসতেন। বহু বছর ধরে এখানে হাট চলে আসছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই ধলগাঁর হাটে নিয়মিত পসরা সাজিয়ে বসেন চম্পক কুন্ডু। তিনি বলেন, সপ্তাহের দুইদিন নিয়মিত আসি। গরম মসলা, জিরা, হলুদ, ডাল, লবণ, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, শুকনা মরিচ ইত্যাদি বিক্রি করি। সাধারণত ঘানিভাঙা সরিষার তেল বিক্রি করি। প্রতি হাটে কমপক্ষে ১০ কেজি সরিষার তেল বিক্রি হয়। তিনি জানান, খুব ছোটবেলায় বাবার কাঁধে চড়ে আসতেন হাটে। দুই পয়সার ভাজা, বিস্কুট কিংবা মিষ্টি-সন্দেশ পদ্মপাতায় মুড়ে দিতেন দোকানিরা। সেই দুই-চার পয়সার মিষ্টি খেয়ে উঠা দুষ্কর ছিল। বল্লারমুখ গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেব কুমার দে হাটের দিন ধলগাঁ বাজারে তার পৈতৃক দোকানের বারান্দায় বসেন পসরা সাজিয়ে। অন্যদিনগুলোয় মালামাল থাকে দোকানের ভেতরে। তিনি তামাক পাতা, জর্দা ও খাবারের মসলা এবং বিভিন্ন ধরনের রশি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে আমি এখানে ব্যবসা করছি। তারও আগে বাবার সঙ্গে আসতাম। ১৯৭৯ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি।
জানতে চাইলে ধলগ্রাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান সরদার বলেন, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি এই হাটের কথা। দেড় থেকে দুইশ বছরের পুরোনো তো হবেই। এক সময় এই হাটটি বিখ্যাত ছিল পাট ও ধানের জন্য। আমরা দেখেছি, ধলগাঁ বাজারের ঘাটে বড় বড় নৌকা থাকত পাট ও ধান কিনে নেওয়ার জন্য। তিনি জানান, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এখানে প্রায় ১০ একর জায়গায় দোকানপাট ও হাট বসে। প্রায় সাড়ে তিনশ স্থায়ী দোকান রয়েছে। মৌসুমে এই বাজারে হাটের পরদিন কমপক্ষে ১০-১২ ট্রাক পাট আর ৮-১০ ট্রাক ধান লোড হয়ে থাকে। অন্য সময় গড়ে এক বা দুই ট্রাক মালামাল লোড হয়। পাট প্রতিটি ট্রাকে আড়াইশ থেকে তিনশ মন এবং ধান ৫০০ মন লোড করা হয়। ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের এই ধলগাঁ বাজার ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন। বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, তারাও বহুকাল ধরে এই হাটে বিকিকিনি করেছেন। নদীর ঘাট উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছা আছে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন: পেট্রাপোল বন্দরে বেনাপোলের আলোচিত হাসানুজ্জামানের ১৫ কোটি টাকার পণ্য জব্দ