কল্যাণ ডেস্ক
ঢাকা শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। বেশির ভাগ শিশুই জ্বরে আক্রান্ত, দিনের পর দিন সর্দিকাশিতে ভুগছে। এই হাসপাতালে ভর্তি প্রতিটি শিশুর অভিভাবকদের একই বক্তব্য- ‘দিনের পর দিন সর্দিকাশিতে ভুগেই বাচ্চাটা দুর্বল হয়ে গেছে। খেতেও চাচ্ছে না এখন আর। তাতে করে আরও বেশি নেতিয়ে যাচ্ছে। তবে জ্বরের বিষয়টি একটু কেমন যেন। কখনো থেমে থেমে, আবার কখনো একটানা। একদিন তীব্র ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে পরদিন থেকে সেটা হাওয়া।’
শুধু এই শিশু হাসপাতালই নয়, রাজধানীর প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই এখন শিশুদের ভিড়। সবাই একই লক্ষণ-উপসর্গে আক্রান্ত। তবে তারা কোন রোগে আক্রান্ত সেটি নিশ্চিত হতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তাদের সন্দেহ, অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ এভাবে ঠাণ্ডা-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
তবে এই ভাইরাস শনাক্ত করা নিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর ও সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে। আইইডিসিআর বলছে, কেউ অ্যাডিনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে- এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে না এলে সে নিয়ে কাজ করার নিয়ম তাদের নেই।
আর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের ভাইরাসটি শনাক্ত করার সক্ষমতা নেই। এই সক্ষমতা শুধু আইইডিসিআরের আছে। তবে অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ-উপসর্গ পেলে যে আইইডিসিআরকে জানাতে হবে, সে ধরনের কোনো নির্দেশনা তারা পাননি। এদিকে আইইডিসিআর ও হাসপাতালের এমন ঠেলাঠেলিতে বিপাকে পড়েছেন রোগী ও তাদের স্বজন এবং চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে জানতে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীনের ফোন নম্বর গতকাল বন্ধ পাওয়া গেছে। এর আগের দিন সোমবার তিনি ফোন কেটে দিয়েছিলেন।
তবে প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র কোথাও যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখা যায়, তখন আইইডিসিআর খবর পেয়ে সেখানে সার্ভিল্যান্স চালায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশে শিশু হাসপাতাল বা অন্য কোনো হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড এ ধরনের কোনো খবর দেয়নি। অথবা গণমাধ্যমেও এ ধরনের খবর আসেনি।
তবে অ্যাডিনো ভাইরাস রয়েছে, খুঁজলে পাওয়া যাবে।’ আইইডিসিআর নিজ উদ্যোগে কেন সেটা করছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আইইডিসিআরের নিয়ম। একে বলা হয় ‘ইভেন্ট বেইজ সার্ভিলেন্স’।
একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে। তাদের সন্দেহ, অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণে এমনটা হচ্ছে। এই ভাইরাস নতুন কিছু নয়। এটি করোনা ভাইরাসের মতোই অত্যন্ত সংক্রামক। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাডিনো ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অনুমোদিত কোনো ওষুধ এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আবু সাঈদ শিমুল দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন করোনার মতো একই লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের ভিড় বাড়ছে। করোনার মতোই অ্যাডিনো ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়।
তাই করোনার মতোই রোগীকে অন্যদের থেকে পৃথক থাকতে হবে।’ শিশুদের উপসর্গের মধ্যে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া আর বমি দেখলেই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। তিনি জানান, অ্যাডিনো ভাইরাস শনাক্ত করার সক্ষমতা তার হাসপাতালে নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরই আরেক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ-উপসর্গ পেলে আইইডিসিআরকে জানানোর নির্দেশনা তারা গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পাননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগ সূত্রও বলেছে, তারাও কোনো নির্দেশনা পাননি। অ্যাডিনো ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য যে আলাদা কিট দরকার হয়, সেটি সেখানে নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান পুরো পরিবারসহ এই লক্ষণ-উপসর্গে ভুগছেন। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, অ্যাডিনো ভাইরাসে ভুগলাম, কিন্তু সেটা শনাক্ত হলো না। দেশে আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি এবং বিএসএমএমইউতে শনাক্তকরণ কিট রয়েছে। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য নেই, আমি যতদূর জানি।
ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, সব বয়সেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু শিশু ও বৃদ্ধদের বেলায় মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। তাই এর শনাক্ত করাটা অবশ্যই জরুরি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত অ্যাডিনো ভাইরাস পরীক্ষার কিট হাসপাতালগুলোয় দেয়া। বিশেষ করে করোনার সময়ে যেসব ল্যাব স্থাপিত হয়েছে সেখানে। ল্যাবগুলো চলমান, সেটআপ রয়েছে, শুধু কিট পেলেই পরীক্ষা করা যাবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাক বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অথবা আইইডিসিআর বলছে, কোথাও থেকে অভিযোগ আসছে না। কিন্তু গত এক-দেড় মাস ধরে এই লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালগুলোয় যে চাপ তৈরি হয়েছে, অধিদপ্তর বা আইইডিসিআর থেকে কী বলা হয়েছে হাসপাতালগুলোয় পরীক্ষা করার জন্য? তারা কী কিট দিয়েছে?’
ঢাকার শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, অনেক রোগী আসছে। অ্যাডিনো ভাইরাস নিয়ে সার্ভিলেন্স অত্যন্ত জরুরি, প্রতিটি ভাইরাসের সার্ভিলেন্সই জরুরি। কিন্তু এ হাসপাতালে রোগীদের শনাক্ত করার মতো পিসিআর ল্যাব নেই। শনাক্ত করার ক্ষমতা একমাত্র আইইডিসিআরের এবং তারা নিজ উদ্যোগেই এটা করতে পারে। তাদের সক্ষমতা পুরো দেশজুড়ে। তারা তো ফিডব্যাক চাইলেই পারে।
আরও পড়ুন: নার্সিংই সবচেয়ে বিশ্বস্ত পেশা : প্রধানমন্ত্রী