কল্যাণ ডেস্ক
দেশের সামগ্রীক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে যৌথবাহিনীর কম্বাইন্ড (সম্মিলিত) অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে যৌথবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন এলাকা ও রাস্তায় চেকপোস্ট স্থাপন করে তল্লাশীসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় মানুষ উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে পড়েছেন। দেশব্যাপী এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। সন্ত্রাসীরা দিবালোকে সড়কে, বাসে, অটোরিকশায়, এমনকি বাড়ি ফেরার পথে সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন উদ্বেগজনক অবনতির কারণে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছেন।
এমন পরিস্থিতে গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, সন্ধ্যার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম টের পাওয়া যাবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক দাবি করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপারে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমার মনে হয় কোনো মিডিয়ায় এমন লেখে নাই, এ বছর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। যেহেতু আমি নিজেও এক সময় সাংবাদিকতা করেছি, আমরাও কোনো দিন করি নাই। কিন্তু এখনো যে পরিস্থিতি, আগের মতোই অবস্থা। আমি বলবো, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্যাটিসফ্যাকটরি (সন্তোষজনক)। তবে এটার উন্নতি করার অবকাশ রয়ে গেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আগে কী হতো, যেমন বনশ্রীর ঘটনাটি জানতে জানতে দুদিন সময় লেগে যেতো, এখন সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা জেনে যায়। ছোটখাটো ঘটনা সবসময় আগেও ঘটেছে, দু-একদিন আগেও ঘটেছে। তবে, ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে এজন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরা চাই না, এ ধরনের একটি ঘটনাও ঘটুক।
মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে, মানুষকে কীভাবে আশ্বস্ত করতে চান? জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, উপদেষ্টা হিসেবে আশ্বস্ত করার জন্যই তো আজকে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং করলাম। তাদের একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছি, তারা যেন সন্ধ্যার (সোমবার) পর থেকেই কাজ শুরু করে। আপনারা এটি সন্ধ্যার পর থেকেই টের পাবেন।
এর আগে সারা দেশে ছিনতাই, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতার অভিযোগ করে তার পদত্যাগের দাবিতে গত রোববার মধ্য রাতে উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাত সোয়া ১টার দিকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের দাবি করেন ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’এর ব্যানারে আন্দোলনকারীরা।
অপরদিকে গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে স্বর্ণ-ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তাকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে প্রায় ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ও এক লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজধানীবাসী। বিশেষ করে ঘটনাস্থল বনশ্রীসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি গ্রুপে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় শুরু হয়।
পরে সোমবার রাত থেকেই স্থানীয়রা রাতভর সম্মিলিত পাহারার উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্ষুব্ধ এলাকবাসীর বলছেন, সরকার যেহেতু আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদেরই নিতে হবে। তাই সোমবার রাত থেকে সবাই মিলে ব্লকভিত্তিক পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সম্মিলিত পাহারা দেওয়ার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক গ্রুপে রিদওয়ান খান নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের তো প্রতিদিনই রাত জাগা হয়। একটা বড় টিম হয়ে কাজ করেল এবং পাঁচটা বাইক নিয়ে অন্তত ১০ জন মানুষ একসঙ্গে বনশ্রীতে সারারাত ঘুরলে অনেকটুকু বিপদ কাটবে। রিদওয়ান খানের আহ্বানে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ সাড়া দেন এবং পাহারার কাজে নিজেদের অংশগ্রহণের আগ্রহ জানান। সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলার উদ্যোগের কথাও জানান রিদওয়ান খান।
ফারহান নামে আরেক বাসিন্দা লিখেন, সবাই যেহেতু পাহারাদার হওয়ার কথা ভাবছেন, এ ক্ষেত্রে বনশ্রীর প্রতিটা বাসার সামনে তিন থেকে চারজন করে থাকলে এক রোডেই ৫০ থেকে ৭০ জন হয়ে যাবে। কাজেই এত গ্রুপ করার ঝামেলা থাকবে না। একমত হইলে পরবর্তী দিন থেকেই নেমে পড়েন। আমিও আছি।
জানা গেছে, প্রতিদিনের মতো দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে স্বর্ণ-ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তাকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে প্রায় ২০০ ভরি স্বর্ণ ও নগদ এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।
আনোয়ার হোসেন জানান, তিনটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা ৭জন এসে আমাকে গুলি করে। তারা সোনাসহ টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। তাঁর দুই ঊরুতে ও অণ্ডকোষের নিচে গুলি লাগে।
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ গতকাল বলেন, ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের দোকান বনশ্রী ডি ব্লকে। প্রতিদিনের মত তিনি দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার সময় তাঁকে তিনটি মোটরসাইকেলে করে আসা সন্ত্রাসীরা ঘিরে ধরে। তাকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে এবং ছুরিকাঘাত করে। তাঁর শরীরে গুলি ও কোপের চিহ্ন রয়েছে। এ সময় তাঁর কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করা হয়। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। তার স্বজনরা হাসপাতালে ব্যস্ত থাকায় আসেতে পারেনি। তারা আসলেই মামলা নেওয়া হবে। এখনো কাউকে আটক বা চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেশন করে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা ও গ্রেপ্তারের চেস্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে ছিটকে পড়ল বাংলাদেশ