এক.
আজ বিশ্ব মা দিবস। আজ শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরি বিশ্বের সকল মাকে। পৃথিবীতে এতো সুন্দর আর মধুর ডাক আছে কিনা জানি না। তবে আমাদের মা শুধু মা’ই না তিনি একাধারে আমাদের বাবা, মা, বন্ধু এক কথায় আমাদের পৃথিবী। সংসারে আমার বাবা ছিলেন না। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। এখনও যদি পাঁচটি আপেল ডাইনিং টেবিলে থাকে, মা পাঁচজনকে একটি করে সব গুলো আপেল দিয়ে শূন্য হাতে নিজ থেকেই বলতে থাকবেন আমি আপেল খাই না রে! আপেল খেলে আমার পেটে খুব গ্যাস হয়, ব্যথা হয়।
জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল।’ এটা বাস্তবিক জীবনে প্রায় সকলের জন্যই প্রযোজ্য। নেপোলিয়ান বোনা পার্ট বলেছিলেন, ‘Give me a good mother I will give you a good nation’ আমাকে একটি ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি দেবো। একজন মা-ই পারে তাঁর সন্তানদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় সন্তানদের বাবা হয়তো থাকে জন্মদাতা হিসেবেই। সন্তানের লালন পালন, পড়াশোনা ও সার্বিক খোঁজ খবর মাকে-ই নিতে হয়। সন্তানের গতিপথ ও নব-নব সবই শেখে মায়ের কাছ থেকে। খুব ছোট বেলায় আমার মনে আছে যে আমি ভাবতাম আমার মা-ই বিশ্বের সব চাইতে জ্ঞানী মানুষ। অবশ্য বড় বেলায় এখনো আমার ভাবনা একই রকম রয়েছে। আমাদের সব ভাই-বোনের আজকের যে অর্জন সবই তাঁর কারণেই। মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ, মা-ই হচ্ছেন শিশুর সর্বোৎকৃষ্ট বিদ্যাপীঠ।
আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলেন সংসার বৈরাগী মানুষ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের করাচী থেকে দেশ মাতৃকার ক্রান্তিলগ্নে দেশে এসে সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমার ফুপাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার মোহাসীন ভাই এর কাছ থেকে শুনি বাবার গল্প। কিভাবে দেশে পালিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে আসছিলেন আর একজন সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কি করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। আমার বাবা বেঁচে থাকালীন সময়ে কখনো দেখিনি কারো সাথে বীরত্ব দেখাতে। সংসার বৈরগ্যের কারণে যতোদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আমাদের নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিলোনা বল্লেই চলে। আমার বাবার বাড়ী নারায়ণগঞ্জ এর সোনারগাঁও এর কাজিরগাঁও গ্রামে। ১৯৯০ সালে আমার বাবা মোঃ আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করলে আমার মা আমাদের সব ভাই-বোন কে নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিয়ে আসেন। কেশবপুর উপজেলা শহরেও আমার নানার বাড়ী আছে। তবে তিনি সেখানে আমাদের রাখেননি যে আমরা বাজারের ছেলেদের সাথে মিশে বখে যাবো।
রাজধানী ঢাকা থেকে মঙ্গলকোট গ্রামে এসে আমার মা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়লেও আমাদেরকে কখনোই বুঝতে দেননি। প্রতিদিনই তিনি কাঁদতেন আমাদের অগোচরে। সেই সময় আমার মাকে আমি দেখেছি একদিকে তিন প্রচন্ড কড়া একজন মা, একজন সফল মালিক ও অভিভাবক। আমরা যে বাবাকে হারিয়ছি কখনো বুঝতে দেননি। বাবা থাকতেও আমরা যে আদর ভালবাসা পাইনি আম্মা তার সবটাই দিয়েছেন। বাবার পেনশন রেশন ইত্যাদির জন্য আমার বড় ভাইটাকে ও আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকাতে। আমার মায়ের খালু এক সময়ে যশোর-৬ এর সাংসদ গাজী এরশাদ আলী নানার মাধ্যমে একটি মালবাহী ট্রাক কেনা হয়েছিলো যা ট্রাক ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেয়েছিলেন তিনি। আমার আম্মা প্রায় প্রতিদিনই কেশবপুরে নানার বাসায় যেতেন টাকা পয়সার হিসাব করতে। ছোট বেলায় আমার কখনো মনে পড়ে না আমাদের ভাই-বোন কাওকে তিনি টাকা আনতে পাঠিয়েছেন। তখন আমার নানার বাড়ীর গ্রামে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হতো। সেগুলো আমাদের নানীর ভাগরাদার ছিলো তাদের দিয়েই বিক্রি করাতেন। পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে এ কারণে কখনো আমাকে বা অন্য ভাইদের বাজারে পাঠাতেন না। তবে আমার ছোট ভাইটা ভাল বাজার করতে পারতো বলে সে মাঝে মাঝে বাজার করতো বিকেলে। আমাদের সন্ধ্যার পরে কখনো বাড়ীর বাইরে যেতে দিতেন না। আজ আমরা যখন আমাদের সেসব দিনের কথা ভাবি মা অনকটাই আপ্লুত হয়ে পড়েন! গ্রামে আসার পর আমাকে গ্রামের বাড়ীর পাশে একটা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন আমার ছোট ইলিয়াস বিন কাশেম রাসেলকেও। আমার ছোট বোন ফারহানা তখন খুব ছোট স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। প্রতিদিনই নিজে আমাদের পড়াতেন এবং কড়া শাসনের মধ্যে জীবন চলতে লাগলো। আমি সে বছর গ্রামের ওই প্রাইমারীর মধ্যে মাত্র তিন মাস পড়াশোনা করে রেকর্ড সংখ্যক মার্কস পেয়ে স্কুল ফার্স্ট হই। ক্লাস থ্রী থেকে সরাসরি ক্লাস ফাইভে। আমরা তিন ভাই-বোন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছি।
দুই.
আমাদের ৫ ভাই-বোনের মধ্যে চারজনই সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। আমার বড় ভাই মুহাম্মদ বিন কাশেম জুয়েল রাজধানীতে ঠিকাদারী করেন করেন। বড় বোন ছামিয়া খাতুন গরুর ফার্ম গড়ে তুলেছেন। ছোট ভাই ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করছে। ছোট বোন ফারহানা আফরোজ ঢাকা ব্যাংকে কর্মরত। আজ আমরা যে যেখানেই আছি সব কিছুর কৃতিত্ব আমার মায়ের-ই। পরপর ৪ বার আমার মা স্ট্রোক করেছেন বটে; তবে আজো আমাদের সব কিছুরই নির্দেশনা তিনিই দেন। এখনো কিছুতে ঠেকলে তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। মা-ই আমাদের পৃথিবী। বিশ্ব নারী দিবসে এমন একজন মহিয়সী মাকে জানাই শ্রোদ্ধা, ভালাবাসা, সালাম।
এ পর্যায়ে চীনের পৌরাণিক একটা গল্পের অবতারণা করবো। গল্পটা এমন ‘এক প্রেমিকা তার প্রেমিককে পরীক্ষা করার জন্য বলল, তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাই আমি! প্রেমিক বলল, কী পরীক্ষা নেবে? সব পরীক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত। প্রেমিকা বলল, তোমার মায়ের হৃৎপি-টা নিয়ে আসো! প্রেমে অন্ধ ছেলেটি ছুটল মায়ের কাছে! মাকে হত্যা করে তার হৃৎপি- নিয়ে ছুটল প্রেমিকার কাছে, ভালোবাসার পরীক্ষায় পাস করতে! পথে হঠাৎ আছড়ে পড়ল ছেলেটি। হাত থেকে ফসকে গেল মায়ের তাজা হৃৎপি-টা! ছেলেটি খুঁজে পেয়ে মায়ের হৃৎপি- হাতে নিল। তখনো ধক ধক করছে মায়ের হৃৎপি-। হাতে নিতেই তা বলে উঠল, ব্যাথা পেলি খোকা?’
এটি নিছকই গল্প। কিন্তু বাস্তব জীবনেও সন্তানের প্রতি মায়ের তীব্র ভালোবাসার নিদর্শনও আমরা দেখি। ঘটনাটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। বাড়িতে আগুন লাগার পর মাকে উদ্ধার করেছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু বাড়ির ভেতর তখনো ছোট ছেলেটি। নিরাপত্তাকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বাধা ডিঙ্গিয়ে ছেলেকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন এক মা। আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়ার কারণে তারা বাইরে বের হতে পারেননি। ছেলের সঙ্গেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন সেই মা।
এই ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরই। লঞ্চে করে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের যাওয়ার পথে চলন্ত লঞ্চ থেকে পড়ে যায় তিন মাসের শিশু সন্তান। তাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মা; এরপর দুজনই নিখোঁজ হন। পরে দুজনেরই মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া পত্রিকার পাতায় প্রায়ই চোখে পড়ে সন্তানকে বাঁচাতে জীবন দিয়েছেন মা।
তিন.
মা! এই একটা শব্দ আমাদের জীবনে একটা পৃথিবীর সমান। আমাদের জীবনে মা একটা এমন জায়গা যা আমরা ঠিক সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যায় করতে পারিনা। মা আমাদের সেই গাছতলা যেখানে জীবনের কঠোর তপ্ত রোদের মধ্যে একফালি ছায়া যেখানে আমরা চলার পথে কিছুটা বিশ্রাম পাই। মা আমাদের বাড়ির সেই কোনটা যেখানে আমরা আর সবকিছু ভুল হলে গিয়ে বসে নিঃস্বাস নি। আমাদের জীবনে আমাদের মা ই একমাত্র মানুষ যে এক্কেবারে ভেতর থেকে বোঝে, মায়েদের কিছু বলে দিতে হয়না আমাদের, আমাদের মুখ দেখলেই কেমন করে যেন আমাদের মনের অবস্থা বুঝে ফেলে। আর ঠিক সময়মত সঠিক সমাধান চলে আসে হাতের কাছে।
এমন কোনো অনুভূতি নেই আমাদের মায়েরা আমাদের জীবন সম্পর্কে জানেনা বা তার জন্য আমাদের সঠিক সমাধান বলে দিতে পারেন না! একজন মা ১০ মাস ১০ দিন তার সন্তান কে জঠরে লালন করে এক দিনের মধ্যেই হয়ে ওঠে মা যার ভাবনা ভালোবাসা তার সন্তান ও আর বাকি পৃথিবীর সমস্ত সন্তানের প্রতি একই থাকে। জীবনে যে মানুষের কাছে তার মায়ের ¯েœহ থাকে। সে সেই ¯েœহ ভালোবাসার জোরে সারা পৃথিবী জয় করতে পারে। এমন কোনো পরিস্থিতি জীবনে থাকেনা এমন কোনো অসুবিধে আমাদের জীবনে থাকে না যা আমাদের মা ঠিক করে দিতে পারে না।
একজন লেখক বলেছিলেন, আমি বোকা হতে পারি, অনেক খারাপ ছাত্র হতে পারি, দেখতে অনেক কালো হতে পারি, কিন্তু আমার মায়ের কাছে আমিই শ্রেষ্ঠ সন্তান। মা মানে আদর, মা মানে শান্তি, মা মানে ছায়া। কখনও কি একবার ভেবে দেখেছি একজন মা কতোটা অসহায় হতে পারে? অথচ শত শত মা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন..বাস স্থানের অভাবে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকেন..এগুলো তো আমাদের জন্যই হচ্ছে..কতো না কষ্টে তারা আমাদের গর্ভে ধারণ করেছেন বিনিময়ে আমরা তাকে কিছুই দিতে পারিনি। তাই আসুন আমরা সবাই মা কে ভালোবাসি যেন বিদ্রাশ্রম বা রাস্তা কোন মায়ের স্থান না হয়। যেন কোন মা অনাহারে দিন না কাটায়। পৃথিবীর সকল মায়েদেরকে -Mother’s Day এর সহজ শ্রদ্ধা ও ভুবন ভুলানো ভালবাসা জানাই।