যশোরের চাঁচড়ার প্রকল্পে দীর্ঘ হচ্ছে সংকট
। অনেক ঘরে ফাটল । ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই । রাস্তার দুরাবস্থা । বখাটেদের উৎপাত । নেই ডাস্টবিন । বৃষ্টির পানি বারান্দা ছাপিয়ে প্রবেশ করে ঘরে । খাবার পানি সংকট
আবদুল কাদের
সামান্য বৃষ্টি হলেই যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১১২ ঘরের বাসিন্দারা আতংকে থাকেন। কেননা অপরিকল্পিতভাবে ঘরগুলো তৈরি করায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আবার ঘরের বারান্দার উচ্চতা ও রাস্তা সমান হবার কারণে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে পড়ছে। খাবার পানি সংকট রয়েছে। নেই কোন ডাস্টবিন। এসব সমস্যার কারণে কয়েকটি পরিবার তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে ঘর দিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন।
প্রকল্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এসব সমস্যার পাশাপাশি রাস্তা না থাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা এবং ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য নেই স্কুল। তারপরও সরকারের ঘরে পেয়ে সবাই খুশি মনে বসবাস করছেন।
যশোর সদর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে চাঁচড়ায় ১০০টি ঘর ভূমিহীনদের হাতে দেওয়া হয়। পরে সেখানে আরও ১২টি ঘর তৈরি করে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন সেখানে ১১২টি পরিবার বসবাস করে। প্রকল্পের আগে সেখানে ঘিঞ্জি ঘনবসতি আর দুর্গন্ধময় পরিবেশ ছিল। যে কারণে অনেকে সেটাকে বস্তি বলে অভিহিত করত। এখন ঘর নির্মাণ করে পরিবেশ পাল্টে দেয়া হয়েছে। সেখানে ঘর নির্মাণের পাশাপাশি রয়েছে বিনোদন কেন্দ্র ও পুকুর। ঘরের বাসিন্দারা নিজেদের অর্থে একটি মসজিদ নির্মাণকাজ করছেন। এজন্য তারা সরকারসহ বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মো. হারুন জানান, এই প্রকল্পের মধ্যে কোনো রাস্তা ও ড্রেন নেই। তাই বৃষ্টি হলেই পানি জমে যাবার পাশাপাশি পানি ঘরে উঠে যায়। আর চাপকলগুলোতে আয়রন। পানি খাওয়া যায় না। বাইরে থেকে পানি আনতে হয়। শুনেছি সাবমার্সিবল বসানো হবে। তখন হয়তো পানি আমরা ব্যবহার করতে পারব।
৪৬ নম্বর ঘরের বাসিন্দা চান মিয়া জানান, বৃষ্টি হলেই পানি আটকে যায়। এতে তাদের বড় সমস্যা হয়। এখানে কোনো ড্রেন নেই। আর ঘরের মেঝে প্রায় মাটির সঙ্গেই। তাই বৃষ্টি হলেই পানি ঘরে চলে আসে। আমাদের এখানে ১৫টি চাপকল আছে। কিন্তু চাপকলের পানি খাওয়া যায় না। আর পানি ব্যবহার করলেও সেই পানিও আটকে থেকে সমস্যা সৃষ্টি করে। আলাদা কোন রান্না করার জায়গা নেই। যেকারণে বারান্দায় আমরা সবাই রান্নার কাজ করে থাকি।
৭০ নম্বর ঘরের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, আমাদের এখানে কোন ডাস্টবিন নেই। প্রতিদিনের রান্নার বর্জ্য আমাদেরকে বাইরে গিয়ে ফেলে আসতে হচ্ছে। আবার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও নেই। যদি পৌরসভার গাড়ি এখানে আসতো, তাহলে আমরা স্বস্তি পেতাম। টয়লেটগুলো নিচু স্থানে করার কারণে পানি নিস্কাশিত হয়না। এটা বড় সমস্যা সবার জন্য।
আরেক বাসিন্দা জামির আলীর স্ত্রী জয়বুন নেছা বলেন, আলাদা রান্নার জায়গা নেই। ডাস্টবিন না থাকার কারণে সবাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। আবার কিছু ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে।
আশ্রয়ন প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ পাওয়া সোহরাব হোসেন বাদশা বলেন, দুটি ছোট ঘর হবার কারণে আমি ছোট ভাইকে দিয়ে আলাদা ভাড়া বাসায় থাকি। এখানে পানি বের হবার কোন ড্রেন নেই। এক ঘরের সামনে আরেক ঘরের ব্যবধান মাত্র ৪ ফুট। মাঝখানে সরু রাস্তা দিয়ে চলাচল করাই দায়। এতো মানুষের বসবাস হলেও করা হয়নি মসজিদ। তবে আমরা সবাই মিলে মসজিদ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। বাদশার মতো শফি, রাজিম, মেনি ও ফতে নামে কয়েকজন তাদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন।
জামিলা নামে অপর বাসিন্দা বলেন, আমাদের প্রকল্পে রাখা হয়নি কোন বিদ্যালয়। যেকারণে পার্কের মধ্যে একটি ছোট ঘরে ছেলে-মেয়েদের পড়ানো হয়ে থাকে। এদিকে সরকার নজর দিরে সবাই উপকৃত হতাম। নাজমা নামে একজন আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখপড়ার দায়িত্ব পালন করেন।
৮৩ নম্বর ঘরের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, ঘর নির্মাণের সময় তারা বলেছিলেন, পোতা একটু উঁচু করে ঘর বানাতে। কিন্তু তাদের কথা কেউ শোনেনি। মাটির ওপরেই ইট গেঁথে ঘর বানানো হয়েছে। এখন বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি চলে আসে। প্রকল্পের পুকুরের সামনে যে বসার জায়গা বানানো হয়েছে, তাতে বাইরের লোকজন এসে বসে থাকে, আড্ডা দেয়। বখাটেরা উৎপাত করে।
যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের স্বমন্নয়ক মাসুদুর রহমান জানান, সরকারের মহতী এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ঘরগুলো যদি পরিকল্পিভাবে করা হতো তাহলে বাসিন্দারা বসবাস করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বর্ষায় যদি পানি ঘরে ঢুকে যায়, তাহলে বসবাস কিভাবে করবে। তাছাড়া অবশ্যই ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ডাস্টবিন থাকা উচিত ছিল।
যশোর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপ দাশ জানান, চাঁচড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১১২টি পরিবার বসবাস করে। এ ছাড়াও সদরে মোট তিন ধাপে ৫৪১টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৫৫টি ঘর বরাদ্দ এসেছে। এই ঘরগুলো সবই খাসজমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে কোনো জায়গায় রাস্তা ও ড্রেনের সমস্যা রয়েছে। আর কিছু ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে সেগুলো নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। কেউ যদি নিজের নামে বরাদ্দকৃত ঘর নিজের পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে বসবাস করতে দেয় সেটা অন্যায়। এগুলো আমরা খোঁজ নিয়ে তাদেরকে সরিয়ে দেব।