অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের নির্দেশনা
এইচ আর তুহিন: নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সমাজ সচেতন নাগরিকরা। তারা বলছেন, অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে এ ধরনের নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী।
অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভায় অনিবন্ধিত সব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ২৮ মে-র মধ্যে বন্ধ করতে হবে। সারাদেশে অনুমোদনহীন যেসব চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, এরমধ্যে খুলনা বিভাগে রয়েছে এক হাজার ৪৩৮টি। আর যশোরে প্রায় একশত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে চলমান রয়েছে।
যশোরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও যশোর শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু জানান, নির্দেশনা কার্যকর হওয়া জরুরি। কিন্তু পূর্বের আলোকে বলা যায়, এটি আগের মতই ঢিলেঢালা ভাব থাকবে। আর নির্দেশনার মধ্যেও ফাঁক রয়েছে। নিবন্ধনের আবেদন করার পর কতদিন চালু রাখতে পারবে তার নির্ধারিত কোনো সময় দেয়া নেয়। তাই আবেদনের পর দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে চলতেই থাকবে।
তিনি আরও জানান, জবাবদিহিতা না থাকায় অবৈধ ডায়াগণস্টিক সেন্টারগুলোতে চলে অরাজকতা। থাকে না মানবতার উপস্থিতি। এসব সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয় ও হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে করা হয় অপারেশন। তারা ইচ্ছেমতভাবে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যশোর শাখার সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু জানান, বিভিন্ন ডায়াগণস্টিক সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগণস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগণস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। নির্দেশনা দিলেও তা কার্যকর নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, সারাদেশে অলিগলিতে চিকিৎসা সেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ডায়াগণস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালায় রমরমা বাণিজ্য। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই।
যশোরের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন নাজমুস সাদিক রাসেল জানান, ইতিমধ্যে উপজেলাগুলোতে নির্দেশনার চিঠি দেয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী খুব শিগগির অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। কেউ রেহায় পাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বুধবার অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবিরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ৪টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এগুলো হলো- আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারসমূহ বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন গ্রহণ করলেও নবায়ন করেনি, তাদের নিবন্ধন নবায়নের জন্য সময়সীমা প্রদান করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন গ্রহণ না করলে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে অপারেশনের সময় অ্যানেস্থেসিয়া প্রদান ও ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স প্রদানের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন সরকার সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশব্যাপী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহের নিবন্ধন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে আবেদন জমাদানকারীদের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেননি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে; কিন্তু দিব্যি চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। আবার কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে বছরের পর বছর। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসাসেবার নামে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবসা।
ডা. নাজমুস সাদিক রাসেল আরও বলেন, ইতিমধ্যে অবৈধ ও অনিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক বরাবর আইন প্রয়োাগকারী সংস্থার সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।