জাহিদ হাসান
সীমান্ত উপজেলা চৌগাছা এবং ফুলের রাজধানী ঝিকরগাছার ২২টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-২ সংসদীয় আসন। দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য স্পষ্ট। নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগের মৌসুমি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে ভিড় শুরু করেন। মাঠে সম্ভাব্য ৪-৫ জনের সরব উপস্থিতি থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এ সংখ্যা ডজন ছাড়িয়ে যায়। এদিকে মাঠে সরব উপস্থিতি না থাকলেও প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে বিএনপি। তবে দলের নেতারা বলছেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেই কার্যক্রম চালাচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। এখন তাদের মূল লক্ষ্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন চাঙ্গা করা।
সূত্র মতে, সর্বশেষ ২০১৮ সালে জামায়াতের আবু সাঈদকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করতেই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন দলীয় দিবস ও ধর্মীয় উৎসবে বিলবোর্ড ও ব্যানার টাঙিয়ে দেশের উন্নয়ন এবং নিজেদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। একই সাথে কেন্দ্রে লবিং শুরু করেছেন। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে গ্রুপ-উপগ্রুপ। দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের এক ডজন প্রার্থীর কথা শোনা যাচ্ছে। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন ছাড়াও মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম,
সাবেক বিদ্যুৎ জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বেপজার সাবেক চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাবিবুর রহমান খান, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আলী রায়হান, সহসভাপতি এবিএম আহসানুল হক আহসান, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোস্তফা আশিষ ইসলাম, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এসএম হাবিবুর রহমান, ঝিকরগাছা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক গিলবার্ট নির্মল বিশ^াস, ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম মনির, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী মাসুদ চৌধুরী।
আরও পড়ুন:৩৯ বিঘা জমি নিয়ে বিরোধে মুখোমুখি ব্যারিস্টারপুত্র ও মা
অন্যদিকে, বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে জেলা বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাবেরা নাজমুল মুন্নী, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম, ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোর্তজা এলাহী টিপু, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদুল হাসান, যশোর আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহম্মদ ইসহক। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি আবু সাঈদ শাহাদৎ হোসেন করোনাকালীন সময়ে ২০২১ সালে মারা যাওয়ায় সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আরশাদুল আলমকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারও করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। বিএনপির সাথে সমঝোতার নির্বাচন হলে আগের মত তাদের প্রার্থীই জোটের প্রার্থী হবেন বলে দাবি জামায়াত নেতাদের। এছাড়া জাতীয় পার্টি বা অন্য ছোট দলগুলোরও প্রার্থী রয়েছে।
বর্তমান সংসদ মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘গত চার বছরে সংসদীয় এলাকার দুই উপজেলায় যে উন্নয়ন করেছি তা অতীতে হয়নি। ২৩০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩৭টি স্কুল ও কলেজ ভবন, ১০টি মাদ্রাসা ও ৫৩টি প্রাইমারি স্কুল ভবন, দুটি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ৫২৪টি জমি আছে ঘর নেই পরিবারকে ঘর নির্মাণ, জমি নেই ঘর নেই এমন ৮৪৭ পরিবারকে জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে জনগণের সঙ্গে সুখে-দুখে রয়েছি। সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি এমপি থাকাকালীন চৌগাছা-ঝিকরগাছায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। চৌগাছার কপোতাক্ষ সেতু, চৌগাছা-যশোর মহাসড়ক প্রশন্ত করে উন্নয়নসহ রাস্তাÑঘাট, বিদ্যালয় ভবনসহ নানা উন্নয়নের পরও গত নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়েও আমি এলাকা ছাড়িনি। জনগণের সাথেই আছি। দুই উপজেলায় প্রতি মাসে একাধিক গণসংযোগে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরছি। আশা করি এবার দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।
আরও পড়ুন:জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক একরাম উদ-দ্দৌলা
সাবেক বিদ্যুৎ জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আদর্শে আদর্শিত হয়ে শহীদ মশিয়ুর রহমানের হাত ধরে ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসি। কখনও আদর্শচ্যুত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে অবিচল ছুটে চলা তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে ছিলাম, আছি, আমৃত্যু থাকবো। শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথে একজন কর্মী হিসাবে সাথে আছি। আশাকরি নেত্রী আবারও মনোনয়ন দিবেন এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অংশীদার হবো।
যুবলীগনেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। ক্ষমতা থাকাকালীন অনেক নেতার তৈরি হয়েছে; একই সাথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে। এসব প্রতিযোগিতা অশোভনীয়তা নয়। নৌকা যেই পাবেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকেই বিজয়ী করবো। আমি মনোনয়ন না পাইলেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলাম, এখনো আছি। সরকারের উন্নয়নের চিত্র মানুষের দৌর গড়াতে পৌছে দিচ্ছি। আশা করি নেত্রী মনোনয়ন আমাকে দিবেন। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাবিবুর রহমান খানের সহোদর চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তবিবর রহমান খান বলেন, ভাই দলের মনোনয়ন চাইবেন। আমরা শতভাগ আশাবাদি দল তাকে মনোনয়ন দেবে। তাছাড়া যাকেই মনোনয়ন দিবে তাকে বিজয়ী করতে কাজ করবো। মোস্তফা অশীষ ইসলাম বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সন্তান হিসেবে জন্মের পর থেকেই মানুষের সাথেই গড়ে উঠেছে আমার আত্মিক সম্পর্ক।
ছাত্রাবস্থায় ২০০০ সালে বন্যায় এ জেলার মানুষের সাথে একটানা সাত মাস সাথে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে ডিজিটাল যশোর গড়ার ২০১১ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে মেধা ও শ্রম দিয়ে সক্রিয় সদস্য হিসেবে যশোর গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখি। যার স্বীকৃতি জেলা প্রশাসন প্রদান করেছে। একইভাবে চৌগাছা উপজেলায় স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণে বিশেষ অবদানের জন্য পঞ্চম জাতীয় ভোটার দিবে নির্বাচন কমিশন বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। নতুন ভোটারদের শুভেচ্ছাপত্র বিলি ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যেমে ভোটারদের ডাটাবেজ তৈরি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন প্রচার অব্যাহত রেখেছি। এছাড়া, করোনাকালীন সময়ে ডিজিটালি জনসচেতনতায় টিকা গ্রহণের তথ্য প্রদান তথ্যসহ গণমুখী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট ভোটার ও স্মার্ট সিটিজেন তৈরির কাজ করে যাচ্ছি। দল যদি মনোনয়ন দেয়, স্মার্ট নির্বাচনী এলাকা উপহার দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে মেধার স্বাক্ষর রাখতে চাই।
আরও পড়ুন:চর্ম রোগের আধুনিক চিকিৎসা যশোরে
জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রয়েছে। বিএনপি জনগণের দল। নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির সব সময় রয়েছে। দেশ সুষ্ঠু ও গতিশীল করতে পরিবর্তন চাই দেশের মানুষ।
বিএনপিনেত্রী সাবেরা নাজমুল বলেন, ‘আমি মাঠে ছিলাম, আছি। নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নাই। স্বামী বিএনপি নেতা নাজমুল হোসেন এই সরকারের গুম হত্যার শিকারের পর থেকে জনগণের সঙ্গে মিশে আছি। জনগণের সঙ্গে কাজ করেছি বলেই বিএনপি মূল্যায়ন করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমাকে স্থান দিয়েছে। গত নির্বাচনেও প্রাথমিক মনোনয়ন আমাকে দেওয়া হয়েছিলো। এবারও দল আমাকে দিবে বলে আশাবাদী। তবে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আর দলীয় সভানেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তির যে আন্দোলন সেটাই গুরুত্ব দিচ্ছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাবো না। চৌগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহুরুল ইসলাম বলেন, দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে রয়েছে। দাবি বাস্তবায়নের পর বিএনপি নির্বাচন করলে দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো। তিনি বলেন, ‘আমি ৯১ সাল থেকে মনোনয়ন চেয়ে আসছি। ৮৪ সাল থেকে ৩৪ বছর উপজেলা বিএনপির সম্পাদক ছিলাম, এরপর থেকে সভাপতি আছি। দলে আমার অবদান বিবেচনা করে মনোনয়ন দেয়া হবে বলে বিশ^াস করি। ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোর্তজা এলাহী টিপু বলেন, ‘আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী। নিশ্চয় দল জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থী দেবে।
দুই উপজেলা নির্বাচন অফিসের সর্বশেষ তথ্যমতে আসনটিতে সর্বমোট ভোটার ৪ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৮ জন। চৌগাছা উপজেলায় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫২২ এবং ঝিকরগাছায় ২ লাখ ৫৬ হাজার ৭১৬ ভোটারের মধ্যে মোট নারী ভোটার রয়েছেন ২ লাখ ২৬ হাজার ৬৩ জন।
আরও পড়ুন:বর্ষবরণ ঘিরে যেন প্রাণের ছোঁয়া লেগেছে সংস্কৃতির শহর যশোরে
২ Comments
Pingback: পূর্ব শত্রুতার জের ধরে কাচি দিয়ে যুবকের কান কর্তন
Pingback: লুটপাটের টাকায় আ.লীগের নেতাকর্মীদের ভোগ বিলাসিতা