এ্যান্টনি অপু
জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ৩০ বছর ধরে কবিরাজি করেন এক ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ মন্ডল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরণের চিকিৎসা সেবাকে অবৈধ বা অপচিকিৎসা বলা হয়ে থাকে। তবে নিজে মুখে কবিরাজি করা ও সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন ওই ইউপি সদস্য। ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ মন্ডল যশোরের চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার।
সম্প্রতি গত সোমবার (৮ জুলাই) চৌগাছার উপজেলার রানিয়ালি গ্রামে কথিত জিন সাপের কামড়ের আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে ১২ জন নারী-পুরুষ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সব রোগী জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে সাপের কামড়ের আতঙ্কে তারা স্থানীয় ওই ইউপি সদস্য ও কবিরাজ আব্দুল মজিদ মন্ডলের শরণাপন্ন হয়। এ সময় আব্দুল মজিদ মন্ডল তাদের কথিত জি¦ন সাপে দংশন করেছে বলে গাছের শিকড়-বাঁকড় দিয়ে জড়িবুটি দেন। পরবর্তীতে রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের স্বজনরা যশোর জেনারেল হাসপাতালে দুপুর ১২টার দিকে ভর্তি করেন।
এদিকে হাসপাতালে ভর্তি ওই সকল রোগীরা জানান, অদৃশ্য বিষধর সাপে কামড়ে গত ১ জুলাই ওই গ্রামের আব্দুল হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৪০) মারা গিয়েছেন। ওই সময় ইউপি সদস্য কথিত কবিরাজ গ্রামবাসীকে জানান, রাবেয়াকে জি¦ন সাপে দংশন করেছে। যে কারণে চিকিৎসা দেয়ার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি। এরপর গ্রামে কথিত অদৃশ্য জিনসাপের আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে।
ওইদিন হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় গৌরচন্দ্র মন্ডল সাংবাদিকদের জানান, তিনি মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। এসময় হঠাৎই মনে হলো তার পায়ে কোন কিছুতে কামড়ে দিয়েছে। এর পরে তার শরীরের মধ্যে জ¦ালা পোড়া শুরু হয়। সে কালিয়াকুন্ডি গ্রামের কবিরাজ আব্দুল মজিদ মেম্বারের কাছে যায়। ওই কবিরাজ হাত চালান দিয়ে দেখে তার শরীরে বিষ রয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক রোগী বৃষ্টি বলেন, সোমবার দুপুরে রান্না ঘরে রান্না করছিলাম। এসময় হঠাৎ করে শরীরে ঝিমঝিম করে মাথাঘোরার মতো হলো। পরে শরীরে জ্বালা-পোড়া শুরু হয়। বৃষ্টি স্বজনদের ঘটনা জানালে তাকে প্রথমে গ্রামের এক মহিলা কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। সে হাত চালান দিয়ে দেখতে পান তার শরীরে বিষ রয়েছে। পরে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ মন্ডল বলেন, ‘আমি সাপে কামড়ানোয় গাছ-গাছড়ার ঔষধ দেই ৩০-৩২ বছর। কবিরাজি করি মানে, একটু গাছ-গাছড়া ঔষধ দেই সময় পেলে।
সাপ আতঙ্কে অসুস্থ ভর্তি রোগীদের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, সোমবারে আমি বাড়িতেই ছিলাম না, যশোরে বিএডিসি অফিস ও পঙ্গু হাসপাতালে কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি।
একজন ইউপি সদস্য ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে কবিরাজি করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘না-না-না ওরাকম কোন কবিরাজি করিনা, টাকা পয়সা নিই না, কবিরাজি নিষেধ সরকারি হিসেবে। সুবিধা অসুবিধায় কেউ আসলে গাছড়ার ঔষধ দিয়ে বলি হাসপাতালে চলে যাও। সাপে কাটা রোগীদের ট্রিটমেন্ট দিয়েছি, সারা বছর যা দিয়ে থাকি, ওই রাস্তার পাশে হওয়া কালকিসিন্দে গাছ-গাছড়া দিয়ে বলেছি হাসপাতালে চলে যাও।
এ বিষয়ে পাশাপোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অবাইদুল ইসলাম সবুজ বলেন, আব্দুল মজিদ মেম্বার গুজব ছড়াইনি। মূলত গ্রামের মধ্যে মুখে মুখে সাপে কাটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় একশোরও বেশি মানুষ অসুস্থ হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আব্দুল মজিদ মেম্বার সাপে কাটার কিছু গাছ-গাছড়ির ঔষধ সম্পর্কে জানে। তিনি গাছড়ার ঔষধ দেয়, বলেন- খেলে খান আর না হলে হাসপাতালে যান।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার আবু হায়দার মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান জানান, কোন রোগীকে সাপে কামড় দেয়নি। সকলে মানসিক আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেডিকেল ভাষায় এই রোগটাকে বলা হয় ‘ম্যাসহিস্ট্রিরিয়া ইন্সেক বাউট’। এটি মূলত মানুষের নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়া হিস্টিরিয়া রোগের পেছনে আরও কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা, শারীরিক অলসতা, ভয়, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, মস্তিস্কের সমন্বয়হীনতা, অন্যতম কারণ। এই রোগে মানুষ অসুস্থ হলে, প্রথমে শরীর ঝিন-ঝিন করে, শরীরে অতিমাত্রা বেড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, সাপে কাটার নামে চৌগাছার থেকে ১২জন নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। তাদেরকে মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। রোগীরা সকলেই সুস্থ আছেন। তাদের শরীরে সাপে কাটার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তারা সকলেই সাপ আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।