নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর সদর উপজেলার ইছালি ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবলীগ নেতা মাজাহারুল ইসলাম নিজেকে গুলি করেছে বলে দাবি করলেও তার সত্যতা পাচ্ছে না পুলিশ। ২ জুন তিনি চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে দাবি করে পুলিশকে জানালেও পুলিশ তদন্ত করে কূলকিনারা পাচ্ছে না। সর্বশেষ মাজাহারুল ফেসবুকে লেখেন, আমাকে গুলি করেছে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ সাজা রাসেলের বাহিনী, রাসেল, আনোয়ার, বার্মিচ মাসুম, ইব্রাহিমসহ ৮ থেকে ৯ জন। এই পোস্টের পর আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন এই যুবলীগ নেতা।
এদিকে, দৈনিক কল্যাণ ঘটনার সত্যতা জানতে গতকাল ওই এলাকায় যায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারে শুক্রবার আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে ইছালি ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর মোড়ে একটা জটলার সৃষ্টি হয়। ওই সময় কয়েকজন লোককে মোটরসাইকেল ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। তবে কেউ কোন গুলির শব্দ শুনতে পাননি।
স্থানীয় এক মসজিদের খতিব জানান, আছরের নামাজ শেষে তিনি হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দ শুনে বাজারের উপর এসে দেখেন অনেক লোকের জটলা বেধে আছে। সবাই বলাবলি করছে একদল সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা মাজহারুলের উপর হামলা করেছে এবং তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। তিনি কোন শব্দ শুনেছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, গোলাগুলির কোন শব্দ শুনিনি সবাই বলছে তাই শুনলাম।
গোলাগুলির এই ঘটনাটি দ্রুততার সাথে চারিদিকে ছড়িয়ে পরলে ডিবি, র্যাব ও পুলিশের একাধিক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় একটি মোটরসাইকেল ও একটি গাছি দা।
গোলাগুলির বিষয়ে ইছালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোকারম হোসেন জানান, অভিযোগকারী যুবলীগ নেতা মাজাহারুল তার উপর সন্ত্রাসী হামলার কথা বলেছেন। এবং হামলাকারীরা তাকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা জানালেও ঘটনার দিন কোন আলামত উদ্ধার হয়নি। তবে শনিবার বিকেলে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩শ গজ দূরে এক রাউন্ড মিস ফায়ার গুলি ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা করা হচ্ছে উদ্ধারকৃত গুলির খোসা অন্তত ৬ মাস আগে ফায়ার গুলির। পরিকল্পিতভাবে কেউ এখানে ফেলে গেছে। বিস্তারিত আরও তদন্তের পর জানানো যাবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী প্রশাসনের একজন সদস্য পরিচয় গোপন রাখার সর্তে জানান, যদি কোন এলাকায় গোলাগুলি হয় তাহলে অবশ্যই স্থানীয়রা গুলির শব্দ শুনতে পাবেন। আর অভিযোগকারীর ভাষ্যমতে ঘটনাটি ঘটেছে বিকেলে সাড়ে ৫ টার দিকে। ওই সময় বাজারে অনেক লোকের সমাগম ছিলো। তাছাড়া গোলাগুলি হয়েছে এমন কোন আলামত উদ্ধার হয়নি। এখন যদি কেউ বলে অত্যাধুনিক অস্ত্র হওয়ার কারণে হামলাকারী অস্ত্রে সাইলেন্সার ব্যবহার করেছে; যার কারণে শব্দ শোনা যায়নি সেটি ভিন্ন বিষয়। অস্ত্রে সাইলেন্সার ব্যবহার সম্ভব কিনা জানতে চাইলে ওই প্রশাসনের সদস্য জানান, এমন অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে সত্য তবে আমাদের কাছে বিষয়টি কাল্পনিক।
যুবলীগ নেতার উপর কিভাবে এই গায়েবি গুলি বর্ষণ হলো সেই অনুসন্ধান করতে যেয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মেলে। স্থানীয় সাবেক এক ইউপি সদস্য জানান, বেশ কয়েক বছর আগেও এমন গায়েবি হামলার স্বীকার হয়েছেন এই যুবলীগ নেতা। ওই সময়কার ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে সে বলেন, হঠাৎ একদিন মাজাহারুলের বাড়ির ভেতর থেকে প্রচন্ড চেঁচামেচির শব্দ শুনে স্থানীয়রা ছুটে যায়। তখন এই যুবলীগ নেতা জানান হাশিমপুর বাজারের বুলি তার ছেলে মুন্না ও রামকৃষ্ণপুরের আব্দুল মান্নান সহ ১০/১২ জন তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়রা যেয়ে সেখানে কাউকে দেখতে পাননি। তবে এই ঘটনায় বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। পত্রপত্রিকাতেও লেখালেখি হয়েছিলো। সাবেক ওই ইউপি সদস্যের মতে পত্রিকার হেড লাইন হওয়ার জন্য এমন গায়েবি হামলার রচনা করেছিলেন মাজাহারুল। যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গোলাগুলি কাণ্ডে। বাস্তবে কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি।
শনিবার সরেজমিন ইছালি ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গেলে দেখা যায় স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। চায়ের দোকানগুলোতে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে এই গায়েবি হামলার বিষয়টি। স্থানীয় এক চা দোকানি দাবি করেন, এসবই নাটক। এর আগেও এমন নাটক করেছেন এই যুবলীগ নেতা। মূলত নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফাঁসাতে এমন গায়েবি হামলা মামলার রচনা করেন তিনি।
অন্যদিকে, গোলাগুলির বিষয়ে শনিবার কায়েতখালি গ্রামের বাসিন্দা মো. হাবিল কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, যুবলীগ নেতা মাজাহারুল ইসলামের সাথে তাদের দীর্ঘদিন ধরে কায়েতখালী বাঁওড় ও গাওঘরা মথুরাপুর পুকুর নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলো। ঘটনার দিন শুক্রবার বিকেলে রাসেল কবির, আনোয়ার হোসেন, ইসমাইল হোসেন, তামিমসহ আরও খেলোয়াড় বন্ধুরা ফুটবল খেলার সরঞ্জাম কিনতে ইছালী যাওয়ার পথে রামকৃষ্ণপুর মোড়ে যুবলীগ নেতা মাজাহারুল ও তার অনুসারীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় প্রাণ বাঁচাতে মোটরসাইকেল ফেলে তারা পালিয়ে যায়। অভিযোগে মাজাহারুলের বিরুদ্ধের রাসেল কবিরকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন যুবলীগ নেতা মাজাহারুল ইসলাম। শনিবার সন্ধ্যায় তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে লাইভে এসে মাজাহারুল ইসলাম পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান। এসময় তিনি বলেন, আমি আর কত ষড়যন্ত্রের স্বীকার হবো। আমাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দেন। এভাবে চলতে থাকলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
স্থানীয় একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাজাহারুল ইসলাম একজনপ্রতিনিধির অনুসারী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ইছালী ইউনিয়নে ত্রাসের রাজ্য তৈরি করেছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদবাজি, মাদক কারবারের একাধিক অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক কারণে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বেশ কিছু দিন আগে ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি গঠন নিয়ে রবিউল ইসলাম নামে এক প্রধান শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ হত্যার হুমকি দিয়েছিলো এই যুবলীগ নেতা। ওই সময় একটি অডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেলে যুবলীগের পদ থেকে তাকে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ।