এবার টাকা তুলছে ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি
আইনের কড়াকড়িতে বেড়েছে উৎকোচের রেট
সালমান হাসান: যশোরে অনৈতিক লেনদেনে চলছে অবৈধ ইটভাটা। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকলে উৎকোচ বার্ষিক দুই লাখ টাকা। ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি অংশ ঘুষ লেনদেনে জড়িত। সিন্ডিকেট গড়ে তুলে প্রশাসন ম্যানেজের নামে ৩ কোটি টাকা আদায়ে মাঠে নেমেছে চক্রটি। দেড়শ ইটভাটা থেকে ওই পরিমাণ টাকা তোলার টার্গেট রয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে টাকা পরিশোধের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জেলার প্রায় বেশির ভাগ ইটভাটাই অবৈধ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরে ভাটা আছে ২৩০। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, অধিকাংশের পরিবেশ ছাড়পত্রের হালনাগাদ নবায়ন নেই। তাই ইট পোড়ানোর লাইসেন্স থাকার পরও বহু ভাটা বৈধ না। ২০ থেকে ২৫টির বেশি ভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
জানা গেছে, ছাড়াপত্র বিহীন অবৈধ ভাটা চালাতে পরিবেশ অধিদপ্তরে টাকা ঢালছে এগুলোর মালিকরা। বিগত দিনগুলোয় অধিদপ্তরের যশোর অফিসে কর্মরতদের একটি অংশ অবৈধ ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে উৎকোচের টাকা তুলত। এই বছর সেই দায়িত্ব পালন করছে জেলার ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি। আর এই বিষয়টি ইট ব্যবসায়ীদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। আর তাদের অনেকে এই অবৈধ অর্থ লেনদেনের বিরোধীতা করে তোপের মুখে পড়েছেন। ভাটা বৈধ হওয়ার পরও নানা রকম ত্রুটি বিচ্যুতি খুঁেজ তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। ব্যবসা পরিচালনা স্বার্থে তথ্য দেয়ার সময় নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়েছেন এসব ইটভাটার মালিকরা। তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সাল থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইটভাটা থেকে ঘুষের টাকা তোলা শুরু করেন। তখন যশোরের ১৮৪টি ইট ভাটা থেকে বছরে উৎকোচ দেয়া হতো আট লাখ টাকা। উৎকোচের হার ছিলো তখন অল্প। আর যখনই আইনের কঠোরতা বাড়ল তাদের ঘুষের রেটও তখন বেড়ে গেল।
২০০১ সালের পরিবেশ বিধি মোতাবেক যেসব ভাটা বৈধ ছিলো সেসব ভাটার অনেকগুলো এখন অবৈধ। বৈধ ভাটা বলতে পরিবেশ ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ইট পোড়ানোর লাইসেন্স থাকা বুঝায়। কিন্তু এক সময়ের বৈধ ভাটাগুলো নতুন আইনে এখন অবৈধ। তাই ২০১৯ সালের আইন অনুযায়ী অনেক ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র হালনাগাদ নবায়ন করা হচ্ছে না। আর এটিকে কাজে লাগিয়ে টাকা লুটছে একটি চক্র। অবৈধ ইটভাটা চালু রাখতে তাদের টাকা দিচ্ছেন এগুলোর মালিকরা।
যশোরের বেশ কয়েকটি পৌরসভার মধ্যে বেআইনীভাবে ইটভাটা গড়ে উঠেছে। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন বলছে, পৌর এলাকার সীমানার মধ্যে ভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু মণিরামপুরে সোহাগ ব্রিকস-১ ও সোহাগ ব্রিকস-২সহ ৫টি ইটভাটা পৌরশহরের মধ্যে স্থাপন হয়েছে। এছাড়া ঝিকরগাছা পৌর এলাকায় ১টি ও অভনগর পৌরসভায় ৩টি ইটাভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।
যশোরের অধিকাংশ ভাটার বৈধতা নেই। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইনের শর্তপূরণ না করায় সেগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন বন্ধ আছে। আর ছাড়পত্র বিহীন ইটভাটা পরিচালনা অবৈধ। গত বছরও পরিবেশ অধিদপ্তর এসব অবৈধ ভাটার অনেকগুলোয় অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয়। অনেক ভাটার চুলা ও চিমনি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এবার সেরকম কিছু করা হচ্ছে না। পৌর ও আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ এলাকায় স্থাপন করা ভাটাগুলো এখন অবাধে চলছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর বার্ষিক দুই লাখ টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ ভাটা পরিচালনার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর এই টাকা তোলার দায়িত্ব পালন করছেন যশোর ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির দুই নেতা। তাদের পাশাপাশি জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে কর্মরতদের কয়েক জনের নামও অভিযোগে উঠে এসেছে। অভিযোগের তীর অফিসটির সহকারী পরিচালক হারুন-অর-রশিদ. পরিদর্শক জাহিদ হাসান ও হিসাব রক্ষক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। আরেকদিকে অভিযোগের তীর ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি নাজির আহমেদ মুন্নু ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা বাবুলের বিরুদ্ধে।
তবে সমিতির সভাপতি নাজির আহমেদ মুন্নু ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা বাবুল অভিযোগের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এরকম কোন বিষয় তাদের জানা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের যশোর জেলা অফিসের হিসাব রক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, তার বিরুদ্ধে এটা একটা অপপ্রচার। অনেক অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু সত্যতা কতটুকু সেটি যাচাই-বাছাই করতে হবে। তিনি বলেন, কারোর যদি আমার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকে তারা লিখিতভাবে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করুক। প্রমাণ হলে তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। পরিদর্শক জাহিদ হাসান বলেন, উচ্চমান সহকারী থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়ে তার এখন ফরিদপুর অফিসে বদলি হয়েছেন। অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদের মুঠোফোনে বারবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি।
অধিদপ্তরের যশোর অফিসের উপপরিচালক সাইদ আনোয়ার জানান, আইন অনুযায়ী শর্ত পূরণ করছে না সে সব ইটভাটার ছাড়পত্র হালনাগাদ নবায়ন করা হচ্ছে না। অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলছে। তার দপ্তরে কর্মরতদের একটি অংশ অবৈধ ইটভাটা মালিকদের কাছে ৩ কোটি টাকা আদায়ের টার্গেটে নেমেছে এমন অভিযোগের ব্যপারে তিনি বলেন, এরকম কোন কিছু তার কাছে নেই। অভিযানের মুখে অনেক অবৈধ ভাটা মালিক ব্যবসা চালাতে পারছেন না। একারণে তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কেউ হয়তো মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে এরকম কোন অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবেন।