শাহোকা শফি মাহমুদ: আজ যে স্থানটি যশোর শহর বলে পরিচিত এক সময় এর নাম ছিল মুড়লীনগরী। বর্তমানের পালবাড়ি-পুরাতন কসবা থেকে শুরু করে এখনকার মুড়লী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই নগরী। কম-বেশি সেই সীমানার মধ্যে আজ ভিন্ন ভিন্ন নামের মৌজার সৃষ্টি হয়েছে। আর মূল মুড়লী শুধু নামের পরিচিতিটুকু নিয়েই যশোর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে টিকে আছে। আজকের মুড়লী যেন সন্তানদের হাতে সংসারের দায়ভার তুলে দিয়ে অন্তিম প্রহর গোনা বৃদ্ধ পিতার মতো।
এই প্রাচীন জনপদ মুড়লী নগরীতে প্রথমে খানজাহান আলীর নেতৃত্বে ইসলামের পতাকা ওড়ে। দক্ষিণ বাংলায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের যাত্রা শুরু হয় যশোরের (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার ) কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার থেকে। পীর গাজী শাহ ও কালু শাহ এর শুভ সূচনা করেন। তাদের মৃত্যুর ৪০ বছর পর আসেন খানজাহান আলী। তার আগমনের সঠিক সময়টা জানা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, ১৪১৪ থেকে ১৪৫৯ সালের মধ্যে কোনো এক সময় তিনি এখানে আসেন। তখন দিল্লির মসনদে সৈয়দ ও লোদী বংশের উত্থান-পতন চলছিল। ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন, খান জাহান আলী হিন্দু-মুসলমানদের বিবাদ মীমাংসা করার জন্য বাংলায় আসেন।
গঙ্গা পার হয়ে নদীয়ার মধ্য দিয়ে ভৈরবের কূল ধরে তিনি প্রথমে বারবাজার আসেন। সেখানে অনেক জনহিতকর কাজ করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদ নির্মাণ। তিনি ছিলেন কামেল পুরুষ। অসাধারণ উচ্চমনের অধিকারী এই মানুষটির আদর্শে এলাকার অন্য ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। খান জাহান আলী বারবাজার থেকে মুড়লী আসেন। এর আগে তার শিষ্য গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁকে মুড়লীতে পাঠিয়ে দেন। তারা এখানে ইসলাম প্রচারের কাজ করতে থাকেন। এই দুই ধর্ম প্রচারক যে জায়গায় আস্তানা গাড়েন সে জায়গার নাম হয় কসবা। এই কসবা ফার্সি শব্দ। এর অর্থ বাজার। ইসলামের সাম্য ও শান্তির আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁর হাতে হাত রেখে মুসলমান হয়। নব্য মুসলিমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা নিতে সব সময় ভীড় করতো। মনে হতো যেন বাজার লেগে আছে। এ কারণে ওই আস্তানার নাম হয় কসবা। এটি আজ মৌজা বলে স্বীকৃত। পরে খান জাহান আলী এখানে এসে অল্প কিছুদিন অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে তিনি তার অনুসারীদের তিন গ্রুপে ভাগ করেন। এক গ্রুপে থাকেন গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁ। তাদের প্রতি মুড়লীতে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। আর এক গ্রুপ বোরহান খাঁর নেতৃত্বে কপোতাক্ষের তীর ধরে ভাটির দিকে যায়। আর খানজাহান আলীর নেতৃত্বে অন্য গ্রুপটি ভৈরব নদের তীর ধরে যায় বাগেরহাট।
বোরহান খাঁ কোথায় গিয়ে ওঠেন তা জানা যায়নি। তবে খান জাহান আলী যে বাগেরহাট পৌছেছিলেন তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। সেখানকার ষাট গম্বুজ মসজিদ তার অমর কীর্তি। তিনি সেখানে শাসক ও সাধক হিসেবে পরবর্তী জীবন কাটান এবং ১৪৫৯ সালে ইন্তেকাল করেন। তার জীবদ্দশায় তিনি এমন সব কাজ করেন যার কারণে মানুষ তাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করতো। সে ধারণা এখনকার মানুষের মাঝেও আছে।
এ দিকে মুড়লী-কসবায় জীবন কাটান গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁ। এখানকার হাজার হাজার মানুষকে আলোর পথ দেখান এই দুই সাধক পুরুষ। এখানকার মাটিতেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন তারা। গরিব শাহর মাজার যশোর কালেক্টরেটের উত্তর-পশ্চিম দিকে ভৈরব নদের তীরে। বাহরাম খাঁর মাজার যশোর শহরের কারবালায়। তার মাজার নিয়ে বিতর্ক আছে। ইতিহাস সমর্থিত সূত্র হলো – খান জাহান আলীর নির্দেশে বাহরাম খাঁ এখানে থেকে যান। এই সূত্র অনুযায়ী কারবালার মাজারটি বাহরাম খাঁর হওয়ার কথা। কিন্তু মাজারটি বোরহান খাঁর নামে চিহ্ণিত করা আছে।
ইসলাম প্রচার ও মানব কল্যাণে গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁর অবদানের কথা মানুষ আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। বিশেষ করে গরিব শাহকে সবাই পীর জ্ঞানে মান্য করে।
যশোর পৌর এলাকায় এই মহান ব্যক্তির মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি গরিব শাহর নামে স্বীকৃতি দিয়েছে যশোরবাসী। প্রতি বছর ৩০ ফাল্গুন তার মাজারে ওরস হয়। এতে ১০ হাজারের বেশি লোকের সমাগম হয়। এছাড়া দেশের দূরদুরান্ত থেকে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে এখানে। পাশের দেশ ভারত থেকেও ভক্তরা আসে মাজার জিয়ারতের জন্য।
যশোরের গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁর বংশধর কেউ নেই। কারণ তারা দুজনই ছিলেন অকৃতদ্বার। তবে তাদের সঙ্গে আগত হায়াত শাহ নামে খান জাহান আলীর আর এক শিষ্যের অধঃস্তন পুরুষরা এখনো আছে। তিনি ছিলেন গরিব শাহ ও বাহরাম খাঁর সাহায্যকারী।
হায়াত শাহ যশোর শহরের পাশের ভেকুটিয়া গ্রামে বিয়ে করে পারিবারিক জীবন শুরু করলে গরিব শাহ তার উপাধি প্রত্যাহার করে নিয়ে খোন্দকার উপাধি প্রদান করেন। হায়াত শাহর মাজার আজও বড় ভেকুটিয়া গ্রামে আছে। এলাকাবাসী এ কবরটি নিমাই শাহর বলে জানে।