কল্যাণ ডেস্ক
গাজা ও লেবাননে আগ্রাসনের জবাবে ইসরায়েলে গত মঙ্গলবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটিতে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরান থেকে সরাসরি ছোড়া হয়। এ হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এর জন্য ইরানকে মূল্য দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, ইসরায়েল সম্ভবত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার দিকে নজর রাখছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানগুলোতে হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। সেজন্য নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার ওপর বড় ধরনের চাপ থাকবে। যেন ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বহু বছর পিছিয়ে পড়ে।
যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা তিনি সমর্থন করেন না। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা মনে করে, ইরানের একটি সমন্বিত গোপন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি ছিল, যা তারা ২০০৩ সালে বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও ইরান কখনো এটি ছিল বা থাকার পরিকল্পনা অস্বীকার করে আসছে।
২০১৫ সালে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তির আওতায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির বিনিময়ে ইরান তার পরমাণু কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপে সম্মত হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তা ভেস্তে যায় এবং পরের বছর ইরান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে শুরু করে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি বিমান হামলার হুমকি থাকলেও এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি স্থাপনা মাটির নিচে নির্মাণ করা হয়েছে। ইরানের কয়েকটি সম্ভাব্য পারমাণবিক কর্মসূচি স্থান সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
নাতাঞ্জ
নাতাঞ্জ হচ্ছে তেহরানের দক্ষিণে পাহাড়ের পাশে সমতল ভূমিতে ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির একটি কমপ্লেক্স। নাতাঞ্জে দু’টি বিশাল পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। সেগুলো হলো: ভূগর্ভস্থ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট (এফইপি) ও স্থল পাইলট জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট (পিএফইপি)। ২০০২ সালে একটি গোষ্ঠী প্রকাশ করেছিল, ইরান গোপনে নাতাঞ্জ নির্মাণ করছে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
এফইপি বাণিজ্যিক স্কেলে সমৃদ্ধকরণের জন্য নির্মিত হয়েছিল, যা ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ রাখতে সক্ষম। বর্তমানে সেখানে প্রায় ১৪ হাজার সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১১ হাজার চালু রয়েছে, যা ইউরেনিয়ামকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন করছে।
নাতাঞ্জ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এমন কূটনীতিকরা এফইপিকে মাটির প্রায় তিন তলা নীচে বলে বর্ণনা করেছেন। ইসরায়েলি বিমান হামলা এর কতটা ক্ষতি করতে পারে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে একটি বিস্ফোরণে এফইপিতে সেন্ট্রিফিউজগুলোর ক্ষতি হয়। ইরান বলছে, এটি ইসরায়েলের আক্রমণ ছিল।
এদিকে মাটির ওপরের পিএফইপিতে মাত্র কয়েকশ সেন্ট্রিফিউজ থাকলেও ইরান সেখানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে।
ফরডো
কোমের বিপরীত দিকে ফরডো একটি সমৃদ্ধ পরমাণু প্রকল্প, যা একটি পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। আর এ কারণেই এ প্রকল্পটিকে এফইপির চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়। ২০১৫ সালে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তির পর ইরান ফরডোকে সমৃদ্ধ করেনি। সেখানে এখন এক হাজারেরও বেশি সেন্ট্রিফিউজ কাজ করছে, যার মধ্যে একটি উন্নত আইআর-৬ মেশিন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করছে।
এছাড়াও, ইরান সম্প্রতি ফরডোতে ইনস্টল করা সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ২০০৯ সালে ঘোষণা করে, ইরান দীর্ঘদিন ধরে গোপনে ফরডো নির্মাণ করছে এবং আইএইএকে তা জানায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তখন বলেছিলেন, ‘এই স্থাপনার আকার ও বিন্যাস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
ইসফাহান
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানের উপকণ্ঠে একটি বড় পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র রয়েছে। এটিতে ফুয়েল প্লেট ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট (এফপিএফপি) এবং ইউরেনিয়াম রূপান্তর সুবিধা (ইউসিএফ) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেখানে ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইডে পরিণত করতে পারে যা সেন্ট্রিফিউজে দেওয়া হয়।
ইউরেনিয়াম ধাতু তৈরির জন্য ইসফাহানে সরঞ্জাম রয়েছে, এটি মূল পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। আইএইএ বলেছে, ২০২২ সালে ইস্পাহানে সেন্ট্রিফিউজের যন্ত্রাংশ তৈরির মেশিন রয়েছে।
খোন্দাব
ইরানে একটি আংশিক নির্মিত পানি গবেষণা চুল্লি রয়েছে, যা মূলত খোন্দাব নামে পরিচিত। পানির চুল্লিগুলি পারমাণবিক বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি করে। কারণ, চুল্লিগুলো সহজেই প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে, যা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মতো পারমাণবিক বোমার মূল তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
২০১৫ সালের চুক্তির আওতায় চুল্লির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে চুল্লির কোর সরিয়ে কংক্রিট দিয়ে ভরাট করা হয় যাতে এটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। চুল্লিটি ‘প্লুটোনিয়ামের উৎপাদন হ্রাসের জন্য এবং সাধারণ অপারেশনে অস্ত্র-গ্রেড প্লুটোনিয়াম উৎপাদন না করার জন্য’ পুনরায় ডিজাইন করা হয়েছিল। ইরান আইএইএকে জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালে চুল্লিটি অনলাইনে আনার পরিকল্পনা করছে।
তেহরান গবেষণা কেন্দ্র
তেহরানে ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে একটি গবেষণা চুল্লি রয়েছে।
বুশেহর
পারস্য উপসাগরের উপকূলে ইরানের একমাত্র চলমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়ার জ্বালানি ব্যবহার করে।
