নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই পরাশক্তি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের ‘অসম যুদ্ধ’ এবং এ যুদ্ধের ফলে যে বৈশ্বিক মন্দা, তাতে বিদায়ী বছরটাতে গোটা বিশ্ব শুনতে পেয়েছে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি চলে গেছে খাদের কিনারে, কোনো কোনো দেশ হয়েছে দেউলিয়া। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধাবমান বাংলাদেশের গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা।
বিগত বছরগুলোর মতো ‘২০২২ সালটাও’ ছিল বাংলাদেশের। বিদায়ী এ বছরটাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতির গল্পে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন অনুচ্ছেদ। সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পালক।
বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেশিরভাগ দেশ পোশাক কেনা-কাটা কমাতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা তৈরি পোশাক কেনে, তারা সবাই পোশাকের ব্যয় কমিয়েছে।
কেউ কেউ পোশাকের জন্য বাজেট-ই রাখতে পারেনি। তারপরও ২০২২ সাল ছিল রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো বছর। বিদায়ী বছরটাতে পণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে। পণ্য ও সেবা খাত মিলিয়ে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশের রফতানি আয়ে নতুন রেকর্ড।
বাংলাদেশ এর আগে কখনও পণ্য রফতানি থেকে এক বছরে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পারেনি। এই আয়ের খবরটা আমাদের কাছে আর নতুন নয়। বিগত দেড় দশক ধরে পণ্য রফতানি থেকে বাংলাদেশের আয় ধারবাহিকভাবে বাড়ছে।
২০১৭ সালে এ খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮ সালে ৩৮ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৯ সালে ৩৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে (গোটা বিশ্ব করোনায় আক্রান্ত ছিল) পণ্য রফতানিতে আয় ছিল ৩৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৪৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার।
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে পণ্য রফতানি থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের চূড়া স্পর্শের বছরটাতে অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ রচনা করেছে ‘রূপকথার গল্প’। বিদায়ী বছরটাতে খুলে দেওয়া হয়েছে বহুল প্রতিক্ষিত, স্বপ্নে লালিত, আবেগমথিত, চেতনায় প্রজ্জ্বলিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্টোরেল, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেলের দক্ষিণ টিউব, সারাদেশে একদিনে ১০০ সেতু এবং ৫০ জেলায় ১০০ মহাসড়ক।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন : ২৫ জুন, ২০২২। দুপুর ১২ টা। স্বাধীনতার পর এমন মাহেন্দ্রক্ষণ বাঙালি জাতির জীবনে এসেছে হাতেগোনা কয়েকবার। এদিন খুলে দেওয়া হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও দেশের সর্ববৃহৎ এই অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ অব্যহত রেখে পূর্বঘোষিত সময়ের মধ্যেই উদ্বোধন ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জে জিতেছে বাংলাদেশ, জিতেছে বাংলাদেশের জনগণ, জিতেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে পদ্ম সেতু উদ্বোধন ছিল রীতিমতো সাড়াজাগানো খবর। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান করে নিয়েছিল পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ছবি এবং নিউজ।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে সারাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে চলে আনন্দোৎসব। জেলায় জেলায় জাকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানও পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে নানা আয়োজনে নিজেদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সুফল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা জুড়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। যোগাযোগের মাইলফল হিসেবে মোংলা ও পায়রা বন্দরের মধ্যে সড়ক পথের সংযোগে উৎপাদন ও পরিবহনে গতি বেড়েছে। পদ্মা-পায়রা ও সুন্দরবনের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে কৃষি ও শিল্পকে ঘিরে। দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রসম্পদ আহরণে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
মেট্টোরেল উদ্বোধন : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২। দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট। উত্তরা উত্তর স্টেশনের কনকোর্স লেভেলের টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) থেকে নিজ হাতে এমআরটি পাস কেনার পর পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে প্রথমবারের মতো চালু হতে যাওয়া মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ।
ট্রেনের সামনে বসা চালকসহ বেশ কয়েকজন। কিছু সময় পর ট্রেনের গার্ড যেমন পতাকা নেড়ে ট্রেন চলার সবুজ সংকেত দেন, তেমনি প্রধানমন্ত্রীও সবুজ পতাকা দুলিয়ে দেশের প্রথম মেট্রোরেলকে চলার সংকেত দিলেন। এরপরই দ্রুত বেগে ছুটে চলল ট্রেন। এর মধ্যে দিয়ে দেশে নতুন এক যুগের সুচনা হলো।
বঙ্গবন্ধু টানেলের পূর্তকাজ সমাপ্তি উদযাপন : বিদায়ী বছরের ২৬ নভেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলর দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এই টানেলের অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর কিছুদিন পরে দ্বিতীয় টিউবের কাজ যখন সম্পন্ন হবে, পুরো টানেলটা আমরা উদ্বোধন করব।’
একযোগে ১০০ সেতু উদ্বোধন : বিদায়ী বছরের ৭ নভেম্বর একযোগে ১০০ সড়ক সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আমরা রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা দিয়েছিলাম।
সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এরই অংশ হিসেবে আজ আমরা একসঙ্গে ১০০ সেতুর উদ্বোধন করছি। সেতুগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭, বরিশাল বিভাগে ১৪, ময়মনসিংহে ছয়, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরে পাঁচটি করে, ঢাকায় দুটি এবং কুমিল্লায় একটি রয়েছে।
একযোগে ১০০ সড়ক উদ্বোধন : বিদায়ী বছরের ২১ ডিসেম্বর সারা দেশের ৫০টি জেলায় ২০২১ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার সম্মিলিত দৈর্ঘ্যের ১০০টি সড়ক ও মহাসড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১০০টি মহাসড়কের মধ্যে ৯৯টি সরকারি তহবিল থেকে সম্পন্ন হয়েছে, বাকি একটি এবং ৭০ কিলোমিটার গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মহাসড়ক পর্যন্ত ৬ হাজার ১৬৮ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এডিবি, ওপেক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (আবুধাবি) তহবিলের আওতায়।
