কল্যাণ ডেস্ক: একসময় এক টাকায় কত কিছু পাওয়া যেত। বরফকলের আইসক্রিম, পাখির ডিমের ছোট্ট চকলেটের প্যাকেট, চুইংগাম, শিঙাড়া, পেঁয়াজি—আরও কত কি! এসবই এখন রূপকথার গল্প মনে হবে। এক টাকায় এখন শুধু মিলছে একটি পণ্য—চকলেট। তা-ও সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে কয়েকটি ব্র্যান্ডের। ওজন কমিয়ে এক টাকা দাম ঠিক রাখতে লড়াই করছে কোম্পানিগুলো।
টাকার মান যত কমেছে, ততই একে একে এক টাকার মূল্যতালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে অনেক পণ্য। কদিন আগেও এক টাকায় পাওয়া যেত ম্যাচ বক্স। এখন এক টাকার ম্যাচ বক্সের দেখাও মিলছে না। এখন একেকটি ম্যাচ বক্সের দাম দুই টাকা। এক টাকার পণ্য তালিকা থেকে সর্বশেষ বাদ পড়া পণ্য এটিই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর মে মাস থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। গত এপ্রিলেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন সরকারি হিসাবে প্রতি ডলারের দাম ১০৬ টাকা। মান কমেছে ২৩ শতাংশ। এক টাকায় আগে যেসব পণ্য পাওয়া যেত সবই কাঁচামাল আমদানি করে বানানো হয়। তার মানে, ১ টাকার কাঁচামালের দাম শুধু ডলারের কারণে ২৩ শতাংশ বেড়ে গেছে।
রেস্তোরাঁ, মনিহারি ও স্টেশনারি পণ্যের বেশ কিছু দোকান ঘুরে এক টাকার পণ্য হিসেবে পাওয়া গেছে শুধু চকলেট। চট্টগ্রামের বায়েজিদ রোডের ফুটপাতে মো. সেলিমের পান-সিগারেটের দোকান। তাঁর কাছে পাওয়া গেল এক টাকার পণ্য—আবুল খায়ের, প্রাণ ও অলিম্পিক কোম্পানির খুদে চকলেট। সেলিম জানালেন, এক টাকা দামের কয়েকটি ব্র্যান্ডের চকলেটের দাম বেশ কয়েক মাস ধরে দুই টাকা হয়েছে। তিনটি ব্র্যান্ডের চকলেট আছে এক টাকা দামের। আগে এক টাকায় ম্যাচ বক্সও বিক্রি করতেন। এখন সেটিরও দাম বেড়ে গেছে।
এক টাকা দামের চকলেটও আর বেশি দিন থাকবে না বলে হিসাব কষে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, চকলেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল চিনি, গ্লুকোজের দাম বাড়তি। ইতিমধ্যে ক্যান্ডির দাম কিছুটা বেড়েছে। এরপরও খুচরায় এক টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সাল থেকে এক টাকার ক্যান্ডি বাজারজাত করে আসছে কোম্পানিটি। টাকার মান কমে যাওয়া কিংবা কাঁচামালের দাম বাড়ার পরও এত দিন পর্যন্ত ওজন কমানোসহ নানা কৌশলে ক্যান্ডির দাম এক টাকা ধরে রেখেছিল তারা।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। কাঁচামালের দাম না কমলে ক্যান্ডির দাম এক টাকা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
টাকার মান যত কমেছে, ততই একে একে এক টাকার মূল্যতালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে অনেক পণ্য। কদিন আগেও এক টাকায় পাওয়া যেত ম্যাচ বক্স। এখন এক টাকার ম্যাচ বক্সের দেখাও মিলছে না।
অনেক দিন আগে এক টাকার চকলেট বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এক টাকার ধাতব মুদ্রা না থাকলে হাসি দিয়ে ক্রেতার হাতে চকলেট গুঁজে দেন খুচরা বিক্রেতারা। এই বিনিময়ের মাধ্যমও আর বেশি দিন থাকছে না।
বাজারে এক টাকার কাগুজে নোটও এখন দুর্লভ। কখন দেখেছেন? নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন না। তবু কালেভদ্রে যে বেগুনি-কমলা রঙের চিত্রল হরিণের এক টাকার নোট দেখা যায়, তা বাজারে ছাড়া হয় ১৯৭৯ সালে। এক টাকার নোটের জায়গা নিয়েছে কমলা-সবুজের দুই টাকার নোট। তবে বাজারে এখনো টিকে আছে এক টাকার ধাতব মুদ্রা। এক পিঠে জাতীয় প্রতীক ও আরেক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি খোদাই করা মুদ্রা এখনো মিলছে। এক যুগ আগে এই মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। ২০০১ সালের ৫০ পয়সার তো এখন দেখাই মেলে না।
এক টাকার পণ্যের রূপকথা
৩৫০ বছর আগে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে ১ টাকায় ৮ মণ বা ৩২০ সের চাল পাওয়ার কথা সবারই জানা। সময়টা ছিল খোরাকি অর্থনীতির। এক টাকার ক্রয়মূল্যও ছিল অনেক বেশি।
সোয়া শ বছর আগে ১৮৯৭ সালে পণ্যের দামে রেকর্ডের সময় ঢাকায় ১ টাকায় পাওয়া যেত ৮ সের ১২ ছটাক চাল। ওই শতকের শেষে টাকাপ্রতি মিলত ১৪-১৫ সের চাল। ভারত ভাগের আগে ১৯৩৯ সালেও বাংলাদেশে টাকায় ১১ সের চাল পাওয়া যেত। সে সময় আজকের দুর্মূল্যের বাজারের চিনি মিলত টাকায় পৌনে সাত কেজি।
এক টাকায় নিত্যপণ্য পাওয়া যেত এই স্বাধীন বাংলাদেশেও। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে এক টাকার কমে পাওয়া যেত প্রতি সের আটা, আলু, লবণ। অবশ্য প্রতি সের চালের দাম ছিল এক টাকার সামান্য কিছু বেশি।
আপনার বয়স যদি চার দশক ছুঁয়ে ফেলে, তাহলেও এক টাকার পণ্যের ক্রমবিবর্তন স্মৃতিতে ধরা দেবে। মেয়েদের ক্লিপ, গ্রামের বরফকলে তৈরি আইসক্রিম, পাখির ছোট্ট ডিমের মতো চকলেটের বাক্স—আরও কত কি।
নব্বইয়ের দশকে ১ টাকার নোট দিয়ে কম করে হলেও ৮টি লজেন্স পাওয়া যেত, শিঙাড়া ছিল ৫০ পয়সা। আইসক্রিম ছিল ২৫ থেকে ৫০ পয়সা, ২ টাকায় ৫০ গ্রাম চানাচুর বা বাদাম পাওয়া যেত।
এক টাকায় নিত্যপণ্য এখন রূপকথার গল্পই মনে হয়। টাকার মান যেভাবে কমছে, তাতে এক টাকার ম্যাচ বক্স, চকলেটও আগামী দিনে রূপকথার গল্পই মনে হবে।
আরও পড়ুন: বৈদেশিক আয় বাড়লে অনিশ্চয়তা কাটবে