বোরো আবাদের ভরা মৌসুম
ডিলারদের কাছে মিলছেনা সার
তদারকির অভাব
আবদুল কাদের: এখন চলছে বোরোর ভরা মৌসুম। কিন্তু আবাদের শুরুতেই দেখা দিয়েছে সারের সংকট। বিশেষ করে এমওপি সার মিলছেনা। কৃষকদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে সব ধরণের সার। এতে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর পকেট ভরবে কালোবাজারিদের। সার নিয়ে প্রশাসনের তদারকি না থাকায় প্রতিবছর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট সারের ডিলার রয়েছে ৩০২ জন। এর মধ্যে বিসিআইসি ডিলার ১৪২ জন এবং বিএডিসির ডিলার ১৬০ জন। গত জানুয়ারি মাসে এসব ডিলারের অনুকূলে সরকার সার বরাদ্দ দিয়েছে টিএসপি ২ হাজার ৮৩৪ মেট্রিক টন, ডিএপি ৬ হাজার ৬৮৪ মেট্রিক টন, এবং এমওপি ৩ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন। ফেরুয়ারি মাসে বরাদ্দ হয়েছে টিএসপি এক হাজার ৮৬৮ মেট্রিক টন, ডিএপি ৫ হাজার ১০ মেট্রিক টন ও এমওপি এক হাজার ৬৭৩ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে মার্চ মাসের বরাদ্দের সারও ডিলারদের মধ্যে বরাদ্দ হয়ে গেছে। এমাসে টিএসপি এসেছে এক হাজার ৯ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩ হাজার ১২৭ মেট্রিক টন ও এমওপি এক হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন।
এসব সার সরকার নির্ধারিত দাম হলো ইউরিয়া কেজি ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকা ও এমওপি ১৫ টাকা কেজি। কিন্তু বর্তমানে এমওপি সার বিক্রি হচ্ছে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) এক হাজার, ডিএপি প্রতি বস্তা সাড়ে ৯শ এবং ইউরিয়া ১১শ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতবার এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ পড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এবার ডিজেল, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় একই জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনের খরচ ২০ ভাগ বেড়ে গেছে। এতে ধান আবাদে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষক।
যশোরের শার্শা উপজেলার শালকোণা গ্রামের কৃষক সাহেব আলী জানান, এখন চলছে বোরা ধান আবাদের ভরা মৌসুম। অথচ এমওপি সার পাওয়া যাচ্ছেনা ডিলারদের কাছে। বাইরে থেকে সার কিনতে হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০ টাকা বস্তা। অন্যান্য সারের দামও বেশি। এভাবে বেশি দাম দিয়ে সার কিনে আবাদ করলে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কিন্তু ধানের দাম পাওয়া যাচ্ছেনা। যা মিলছে তাতে কৃষকের শ্রমের দাম পাওয়া যাচ্ছেনা। তারপরও ফসলের আবাদ করতে হয়, কেননা আমাদের পেশা এটি।
ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকুমরা গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান এবার চার বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন। গত বছর তিনি টিএসপি সার ২২ টাকা, এমওপি ১৬, ডিএপি ১৬ ও ইউরিয়া ১৬ টাকা কেজিদরে কিনেছিলেন। গতবার ৬৫ থেকে ৬৬ টাকায় ডিজেল কিনেছিলেন; কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার তিনি টিএসপি ২৮ টাকা, এমওপি ১৮, ডিএপি ১৮ ও ইউরিয়া ১৮ টাকা কেজিদরে কিনেছেন। আর ডিজেল কিনছেন প্রতি লিটার ৮২ টাকায়। ডিজেল, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি হতাশ।
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার সারের যে দাম বলছে, বাজারে সে দরে সার মিলছে না। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেচ খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কৃষিশ্রমিকের দাম বেড়েছে। কীটনাশকের দাম অনেক বেশি। তবে সেই হিসাবে ধানের দাম বাড়েনি। ধান বেচে খরচই ওঠে না। সংসার চালাব কী করে? চাষাবাদ ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এভাবে ডিজেল, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের চড়া দামের কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ওই কৃষকের মতো জেলার লাখো কৃষক বিপাকে পড়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় এবার এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৪ ফেরুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ৪৯ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে বোরা আবাদ করা হয়েছে।
যশোরে সারের মোকাম হিসেবে পরিচিত নওয়াপাড়া সারের বাজার ঘুরে সব ধরনের সার বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। তিউনেসিয়ায় উৎপাদিত ৫০ কেজির প্রতি বস্তা টিএসপি (কালো) এক হাজার ৫০০ টাকা, টিএসপি (সাদা) এক হাজার ৪০০ টাকা, মিসরে উৎপাদিত টিএসপি এক হাজার ৪০ টাকা ও বুলগেরিয়ায় উৎপাদিত টিএসপি এক হাজার ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া এমওপি ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকা এবং ডিএপি ৮১০ থেকে ৮২০ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ওই সার কিনে মজুত করছেন। পরে তা অন্য জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এ কারণে কৃষকদের বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দীপঙ্কর দাশ বলেন, সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। কোথাও কোনো সংকট নেই। বেশি দামে যাতে সার বিক্রি না হয়, সে জন্য নিয়মিত তদারকি আছে। এ পর্যন্ত কোনো কৃষক বেশি দামে সার কেনার অভিযোগ করেননি। বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
সার ডিলার ওসান এন্টার প্রাইজ, পার্ক ট্রেডার্স ও ফারুক এন্টার প্রাইজের সেলফোনে কল করেও তাদের পাওয়া যায়নি। আবার বৃহৎ সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপের মালিক সাইদুর রহমান লিটুর ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রেডার্স সরকারের সারের ডিলারও।
শার্শা উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, এবার চার বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছি। তবে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি খরচ বেড়েছে সেচ ও চাষে। গত বছর যেখানে সেচে বিঘাপ্রতি গড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, সেখানে সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। কীটনাশকের দামও বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। ফসল করে কিছু থাকছে না। অনেক সময় ঋণ করতে হচ্ছে। বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের কৃষক রফিকুল বিশ্বাস জানান, বোরো ধান আবাদের মৌসুমে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। ডিলাররা বলছেন, সার পাওয়া যাচ্ছেনা। বাজার থেকে কিনলে বেশি দাম পড়ছে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন যশোর জেলা শাখার সভাপতি শাহজালাল হোসেন জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কমের কারণে সারের সংকট চলছে। বরাদ্দ বেশি পাওয়া গেলে এই সংকট থাকবেনা। তবে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন নওয়াপাড়া ক্ষুদ্র সার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী। তিনি বলেন, মূলত আমদানিকারক ও ডিলাররা মিলে সার সংকট তৈরি করছে। অনেক ডিলার রয়েছেন যারা সার তুলেই বাইরে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেন। একারণে সাড়ে ৬শ টাকার এমওপি কৃষক কিনছেন এক হাজার টাকা বস্তা।
এ ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক ও সার মনিটরিং কমিটির সভাপতি মো. তমিজুল ইসলাম খান জানান, সার সংকটের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। সরকার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়েছে। সংকট হবার কথা নয়, তারপরও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। কেউ সংকট সৃষ্টি করলে বা বেশি দাম নিলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।