সুনীল ঘোষ: যশোরের আদালতপাড়ায় এলে অন্য অনেক শব্দের মধ্যে অতি পুরোনো একটি শব্দ যে কারও কানে আসবে। সেটা টাইপ রাইটার মেশিনের খট খট আওয়াজ। অন্য সবখানে এই যন্ত্র জাদুঘরে চলে গেলেও এখনো টিকে আছে এই একটি জায়গায়। নানা রকম পিটিশন, সমন থেকে শুরু করে আদালতের নানা রকম নথি এখনো টাইপ করা হয় পুরোনো এই যন্ত্রে। ফলে টাইপিস্ট পেশার কিছু লোকের দেখা মেলে এখানে। তবে আগের সেই রমরমা নেই।
আব্দুল্লাহ আলম মামুন পেশায় ছিলেন টাইপিস্ট। যশোর আইনজীবী সমিতির সামনে ফুটপাতে বসে টাইপ করে সংসার চলতো মামুন দম্পতির। স্ত্রী ছিলেন যশোর সিটি কলেজের ছাত্রী। সংসারের ঘানি টেনে স্ত্রীর লেখাপড়ার খরচ যোগাতে বড্ড বেগ পেতো হতো তার। কম টাকায় ভাড়া থাকতেন যশোরের নওয়াপাড়ায়। ভাগ্য খুলে যায় ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর। সরকারি চাকরির বয়স ছিল না। পূর্বে আবেদনের জুটে যায় মুদ্রাক্ষরিক কাম টাইপিস্ট পদে চাকরি।
আব্দুল্লাহ আল মামুনের মতো ফুটপাত কিংবা টিনশেডের ঘরে বসে টাইপ করে সংসার চলতো যশোর শহরের অর্ধশতাধিক পরিবারের। এরবাইরে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে টাইপ মেশিনে কাজ হতো। তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে করণীক পদে চাকরি পেতে যেসব অভিজ্ঞতা চাওয়া হতো, তারমধ্যে অন্যতম ছিল মুদ্রাক্ষরিক কাম টাইপিস্ট। যেকারণে টাইপ শেখা অত্যাবশক মনে করতেন অনেকেই।
সময়ের প্রয়োজনে তখন যশোর শহরে বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি টাইপ শিক্ষা গ্রহণের ইনস্টিটিউট। শহরের বেলতলা রোডে পলি কমার্শিয়াল ও প্রেসক্লাব যশোরের দক্ষিণপাশে ভাঙাচুরা একটি ভবনে গড়ে ওঠা জজ কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ছিল সুপরিচিত নাম।
এখানে ভর্তি হতে রীতিমত লাইন পড়ে যেতো। পলি কমার্শিয়ালের মালিক ছিলেন সমির দাশ। অ্যাডভোকেট হোসেন আলী ছিলেন জজ কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের মালিক। তখন শিক্ষার্থীদের এতটাই ভিড় হতো যে; নতুন শিক্ষার্থীর কপালে জুটতো না লেখার মতো ভাল টাইপ মেশিন। হাত সেট হতে সময় লেগে যেতো কমপক্ষে তিন মাস। ভাংড়ি মেশিনে হাত সেট হওয়ার পর ভাল টাইপ মেশিনে বসার অনুমতি মিলতো; টাইম বেধে দেয়া হতো ৩০ মিনিট।
এরমধ্যে অপর ম্যাচের শিক্ষার্থীরা পেছনে এসে ভিড় করতো। এ দুটি ইনস্টিটিউটের বাইরে চৌরাস্তাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল আরও বেশ কয়েকটি টাইপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
গত কয়েকদিন সারাশহর ঘুরে দেখা মেলে ৪টি টাইপ মেশিনের। সোমবার কালেক্টরেট সংলগ্ন বটতলায় বয়োবৃদ্ধ ৩ জন পুরুষ টাইপ রাইটারকে টেবিলে মেশিন নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। ক্যামেরা তাক করতেই তারা উত্তেজিত হয়ে টুল (চেয়ার) ছেড়ে উঠে যান। আশপাশের লোকজন বলেন-কাজ-কর্ম নেই। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে।
মিহির কুমার রায় নামে এক টাইপিস্ট জানান, ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়েও টাইপ মেশিনের খটাখট শব্দের ঝড় উঠতো যশোর শহরের আদালত পাড়ায়। আইনজীবী সমিতি-১ এর সামনের ফুটপাত ও কালেক্টরেট সংলগ্ন টিনশেডের ঘরে বসে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ টাইপ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
দলিলপত্র থেকে শুরু করে যেকোন নথিপত্র লিখাতে বা টাইপ করাতে ধর্না দিতে হতো রাইটারের কাছে। অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ সময়। কাকডাকা ভোর থেকে রাত অবধি শোনা যেতো টাইপ মেশিনের খটখট শব্দ। হাতে-গোনা কয়েকজন টাইপিস্টের আঙুল দেখা যেতো না। টাইপ মেশিনের ওপর তাদের দখল এতটাই বেশি ছিল যে, তারা অন্যদিকে তাকিয়েও ঝড়ের গতিতে টাইপ করতে পারতেন। তারমধ্যে অন্যতম ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চাকরি করেন।
আমি নিজেও টাইপ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি বুঝে টাইপ মেশিন ছেড়ে শিখে নিয়েছিলাম কম্পিউটারে টাইপ করা। যেকারণে এখনো টিকে আছি মন্তব্য করে মিহির রায় বলেন. প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে টাইপ রাইটারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। হাতে লেখা আবেদনপত্রের চলও উঠে গেছে। প্রিন্টের যাবতীয় কাজকর্ম কম্পিউটার-ল্যাপটপ, ট্যাব ও এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে হচ্ছে।
প্রধান ডাকঘর সংলগ্ন জামান কম্পিউটারের মালিক মো. জামান জানান, নতুন প্রজন্মের কাছে টাইপ মেশিন নাম না জানা এক যন্ত্রের নাম। প্রায় ৩ দশক আগে সবার অগোচরে হারিয়ে গেছে এক সময়ের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এই টাইপ মেশিন। সরকারি ও বেসরকারি অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য এখন অভিজ্ঞতা হিসেবে চাওয়া হয় কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক কাম করণিক অথবা এলডিএ কাম টাইপিস্ট।
যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী শ্রাবণী দত্ত জানান, তিনি টাইপ মেশিন দেখেননি’; তবে নাম শুনেছেন। অনুরুপ মন্তব্য করেন যশোর কলেজের ছাত্র খড়কির বাসিন্দা সাগর। সোমবার সন্ধ্যায় মুজিব সড়কে (ঈদগাহ ময়দান সংলগ্ন) ফয়সাল কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গেলে নজরে পড়ে ধুলো-বালু মাখা একটি টাইপ মেশিন। প্রতিষ্ঠানটির একদম পেছনে পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। জানতে চাইলে ফয়সাল হোসেন বলেন, বয়োবৃদ্ধ এক দিদি ও তার মেয়ে দিনভর বসে থাকেন। খুব বেশি কাজ হয় না।
অ্যাডভোকেট জিএম মুছা জানান, টাইপ মেশিনের যুগ চলে গেছে। স্মৃতি ধরে রাখার স্বার্থে হলেও যার এখনো এ পেশায় পড়ে আছেন, তাদের দিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত।