যশোর জেনারেল হাসপাতাল
- ছুটির দিনে থাকে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
- ছটফট করতে করতে মারা যান রোগী
- দুর্ব্যবহার করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা
- ২০২২ সালে ৬৭৪ রোগীর মৃত্যু
শাহারুল ইসলাম ফারদিন
২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক আশা নিয়ে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে আসেন পার্শবর্তী জেলা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার সাফদালপুর গ্রামের ৫৪ বছর বয়সী আলতাফ হোসেন। জরুরি বিভাগে নেয়ার পর পাঠানো হয় করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)। এখানে ইন্টার্ন চিকিৎসক তার চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু রোগী বুকের যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকেন। রোগীর স্বজনরা বারবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ডাকতে বললেও কর্ণপাত করেননি দায়িত্বরতরা। বরং স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক। এক পর্যায়ে ৫টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আলতাফ হোসেন।
এমন ঘটনা হরহামেশা ঘটছে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস ও চলতি বছরের জানুয়ারি ১৪ তারিখ পর্যন্ত ছুটির দিনে সরেজমিনে একই অবস্থা পাওয়া গেছে। ২০২২ সালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে মৃত্যুর সংখ্যা পর্যালোচনা করেও দেখা গেছে বৃহস্পতিবার, শুক্র ও শনিবার ভর্তি হওয়া রোগী বেশি মারা গেছেন।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গেল বছর এ হাসপাতালে নানা রোগে দুই হাজার ৫৭৭ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে শুধু করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৭৪ জন। এরমধ্যে শুক্র, শনি ও রোববারে মারা গেছেন ২৮৯জন।
এদিকে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, করোনারি কেয়ার ইউনিটে সংকট রয়েছে কার্ডিয়ার্ক মনিটর, গ্লুকো মিটার, ডিসি কার্ডিও ভার্সন মেশিনের মতো সহজলভ্য প্রয়োজনীয় ইউকুবমেন্ট। নেই প্রর্যাপ্ত জনবলও।
গত শুক্র, শনি ও রোববার সরেজমিনে হাসপাতালে ভর্তি থাকা একাধিক রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত প্রত্যেক রোগী এখানে আসেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। রোগী ও স্বজনরা প্রত্যাশা করেন সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে পাবেন অক্সিজেন, ভেনটিলেশন ও কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনসহ উন্নত সব ব্যবস্থা। বাস্তবে সিসিইউ থেকে পেশার মাপা আর হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোন কিছুই পাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি ইসিজি ছাড়া অনেক সহজলভ্য পরীক্ষাও এ ইউনিটে হয় না।
হাসপাতাল সূত্র মতে, সিসিইউতে গত বছরের জানুয়ারিতে মারা যায় ৭০জন। এরমধ্যে শুধু শুক্র, শনি ও রোববারে মারা যায় ৩৪জন। জানুয়ারির প্রথম দিন শনিবার। এদিন মারা যায় দুইজন, রোববার মারা যায় আরোও দুইজন। দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে মার যায় চারজন। তৃতীয় সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে দুইজন। চতুর্থ সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে ১০জন ও শেষ সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে মারা যায় ৬জন। নভেম্বর মাস পর্যালাচোনা করে দেখা যায়, এ মাসে মারা যায় ৭৮জন এরমধ্যে শুধু শুক্র, শনি ও রোববারে মারা যায় ৩৫ জন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে মারা যায় পাঁচজন। দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে মার যায় ছয়জন। তৃতীয় সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে দশজন এবং শেষ সপ্তাহের শুক্র, শনি ও রোববারে মারা যায় ১৪ জন।
হাসপাতালের সিসিইউ সূত্র মতে, গত বছরে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হয়েছেন ৬২৮৪ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫৭১৬ জন এবং মারা গেছেন ৬৭৪জন। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে মারা গেছেন ৭০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬২জন, মার্চে ৬৭জন, এপ্রিলে ৪২জন, মে মাসে ৪২ জন, জুনে ৫৮ জন, জুলাইতে ৫১ জন, আগস্টে ৪৭ জন, সেপ্টম্বরে ৩৯ জন, অক্টোবরে ৫৯ জন, নভেম্বরে ৭৮জন এবং ডিসেম্বর মাসে মারা গেছেন ৫৯ জন।
হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি থাকা শহরের মাইকপট্টি এলাকার সরোয়ার হোসেনের ছেলে জসিম উদ্দিন জানান, রোগীদের উন্নত চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছেন এখানকার চিকিৎসকগণ। প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্রে সুস্থ না হলে রোগীকে অন্যত্র রেফার্ড করে দিচ্ছেন তারা। সকালের দিকে নামে মাত্র চিকিৎসকরা রাউন্ডে আসেন। কিন্তু এরপর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলে না। আর জরুরি বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রারের পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসক। অন্য রোগীদের স্বজনরাও একই অভিযোগ করেন।
হাসপাতালের সিসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক আইএমও আবু ইউসুফ বলেন, করোনারি কেয়ার ইউনিটে ২৮টি বেডে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। রোগী গড়ে ভর্তি হচ্ছেন বর্তমানে ৫০-৬০ জন। নেই প্রর্যাপ্ত জনবল। সংকট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার, রোগীদের সেবা করার জন্য ওয়ার্ড বয়। করোনারি কেয়ার ইউনিটের নিজস্ব কোন চিকিৎসক সেবিকা ও কর্মচারী নেই। যশোর মেডিকেল কলেজ ও যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক সেবিকা ও কর্মচারী দিয়ে হয় চিকিৎসা কার্যক্রম। এছাড়াও হাসপাতালে নেই কার্ডিয়ার্ক মনিটর, গ্লুকো মিটার, ডিসি কার্ডিও ভার্সন মেশিনের মতো সহজলভ্য প্রয়োজনীয় ইউকুবমেন্ট। আমরা স্বাধ্যমত চেষ্টা করা সত্বেও জনবল ও ইউকুবমেন্ট ঘাটতি থাকায় রোগীদের সকল সার্ভিস দেয়া সম্ভব হয় না।
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, সিসিইউতে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। বাড়তি রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়। করোনারি কেয়ার ইউনিট ভবনের চতুর্থতলা সম্প্রসারণ হচ্ছে। সেখানে ১০ শয্যার আইসিইউ ও ২০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড হবে। ইতোমধ্যে কাজ শেষ পর্যায়ে।
তিনি অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, সিসিইউতে সংকট রয়েছে ডাক্তারসহ পর্যাপ্ত জনবল। এছাড়াও কার্ডিয়ার্ক মনিটর, গ্লুকো মিটার, ডিসি কার্ডিও ভার্ষন মেশিন, টোফেনিং টি/আই, হার্টে রিং পরানোর জন্য এসটেনটিং, ওপেন সার্জারির জন্য সিএবিজি, এনজিওগ্রামের মতো বেশ কিছু ইউকুবমেন্টের ঘাটতি আছে। তবে হাসপাতালে ইসিজি, ইকো, ব্লাড সুগার লেবেল, সিআরপি, ইউরিন সেরাম, ফ্লিটে লিং ও এমওআরই মেশিনের সেবা পাচ্ছে রোগীরা। এছাড়াও রোগীদের বিনামূল্যে হার্ট অ্যাটাকের ‘নক্সারিন’ (জেনেরিক নাম এনোক্সাপারিন) ইনজেকশন পরপর ৬/৭ দিন দেয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে দামি এই ইনজেকশন পেয়ে মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ অনেক উপকৃত হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
