জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: কাগজি লেবুর চাষ ও কলম ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন তুহিন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে তার। শুধু তুহিন-ই না, অধিকাংশ লেবু চাষি হতাশায় ভুগছেন। কলমের বেচাবিক্রি করে লোকসান পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টাও বিফলে গেছে। অস্বাভাবিকহারে দাম কমায় অনেকে চাষ গুটিয়ে বিকল্প কিছু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
যশোর সদরের দেয়াড়ার শিক্ষিত যুবক তুহিন কাগজি লেবুর চাষ শুরু করেন ২০১৮ সালে। প্রথম দুই বছর ফলন ও দর-দাম বেশি ছিল। যেকারণে আশানুরূপ লাভের মুখ দেখেন তিনি। তৃতীয় বছরের মাথায় (২০২১ সাল) লেবুর দাম কমতে শুরু করে। শুরু হয় লোকসান গোনার পালা।
এ পরিস্থিতিতে কলমের ব্যবসায় বেশি মনোযোগী হন। কিন্তু তাও চলেনি বেশিদিন। লেবুর দর-দাম একাধারে কমতে থাকায় কলম ব্যবসাও লাটে ওঠে। প্রথমদিকে ক্রেতা খুঁজতেন ভাল জাতের কলম। কিছুদিন পর ক্রেতার খোঁজে মাঠে নামতে চাষিদের। কিন্তু ফল ভাল হয়নি। যেকারণে কলমের ব্যবসাও ছেড়ে দেন এই চাষি।
একইদশা চুড়ামনকাটির আরাফাত, দলেরনগর গ্রামের টিপু সুলতান ও বেনাপোলের নারায়নপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের। এসব লেবু চাষি ঋণের জালে জড়িয়ে হতাশায় ভুগছেন। তিনি জানান, চলতি বছরের এপ্রিল মাসেও লেবু কিনতে ক্ষেতে আসতেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
তখন এক হালি (৪ পিচ) লেবু বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা। এপ্রিলের শেষের দিকে দর পতন শুরু হয়। মে মাসে লেবুর হালি ১০ টাকায় নেমে আসে। কৃষি বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল লেবুর ভরা মৌসুম চলছে। যেকারণে দাম কমেছে। টিপু সুলতান জানান, মে মাসের শেষের দিকে দর সর্বনিম্নে নেমে আসে। দাম কমানোর কারণে ক্ষেতে ক্রেতা আসা বন্ধ করে দেয়। লেবু তুলে বাজারে পাঠালে পরিবহন খরচ ওঠে না। এখন পানির দরে লেবু কেজি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
টিপু সুলতান জানান, পাশের জেলা ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কুতুব গাজী নামে এক চাষি ২০১৯ সালে দুই বিঘা জমিতে ২৫০টি সিডলেস (বীজহীন) লেবুর কলম রোপণ করেন। জমি প্রস্তুত, চারা কেনা, রোপণ, সেচ ও সারসহ শ্রমিক খরচ হয়তার এক লাখের কিছু বেশি টাকা। কিন্তু লাভের মুখ দেখতে পারেননি এই চাষি। তিনি আরও বলেন, খোঁজ নিয়ে দেখেছি সবখানে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
যশোর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বছর তিন-চার আগে যশোরে হাতে গোনা কিছু কৃষক কাগজি লেবুর চাষ শুরু করেন। প্রথমদিকে লাভও করেছেন। কিন্তু চলতি বছর দাম কমের কারণে তাদের লোকসানেরমুখে পড়তে হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, করোনাকালে কাগজি লেবুর দাম অস্বাভাবিক হয়েছিল। যেকারণে অধিকাংশ মানুষ বাড়ির আনাচে-কানাচে এমনকি ছাদের ওপরও দু’একটি লেবু গাছ লাগিয়েছেন। এসব গাছে যা লেবু ধরছে, তাতেই পরিবারের চাহিদা মিটে যাচ্ছে। ফলে বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও কমেছে।
শনিবার যশোর বড়বাজারে দেখা যায়-সিডলেস ও চায়না জাতের কাগজি লেবুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা দরে। তবে দেশি জাতের লেবুর পিচ এখনো এক টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তরফনওয়াপাড়ার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, আজ এক কেজি লেবু কিনলাম ১২ টাকায়। ১০ টাকা কেজির লেবু আকারে বড় হলেও সুগন্ধি নেই। স্বাদও ভাল না। তিনি বলেন, বর্তমানে লেবুসহ সবজির দাম বেশ কম। তবে আকাশ ছোয়া দাম উঠেছে নিত্যপণ্যে।
সবজি বিক্রেতা রমজান আলী জানান, ঝিনাইদহ ছাড়াও শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হরেক জাতের প্রচুর লেবু আসছে যশোরের বাজারে। এসব লেবু বারো মাসী। প্রচুর ফলন হয়। যেকারণে সরবরাহে ঘাটতি নেই। এসব কারণে কাগজি লেবুর দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
নিকমল হোসেন নামে আরেক সবজি বিক্রেতা বলেন-যশোরে লেবুর চাষ হয় একেবারেই কম। ঝিনাইদহে অনন্ত ২০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে লেবুর চাষ হয়। এসব লেবু যশোর ছাড়াও চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে লেবুর দরপতনের কারণে কিছু কৃষক বিকল্প ফসল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।