নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর শহরের তালতলা মোড়। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয়দের কাছে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন যশোর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। এসময় তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী পৌর কাউন্সিলর শাহেদ হোসেন নয়ন। তারাও স্থানীয়দের কাছে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন।
একই দিন দুপুর দেড়টা। শহরের পালবাড়ি মোড়ে প্রচারণা দেখা গেছে নাবিল আহমেদকে। এসময়ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভোট প্রার্থনা করতে দেখা গেছে পুলিশের আরেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী কাউন্সিলর জাহিদ হোসেন মিলন। তার নামে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ ডজন খানিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। জাহিদ হোসেন মিলন, শাহেদ হোসেন নয়ন নয়; যশোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী নাবিল আহমেদের প্রচারণাতে অংশ নিচ্ছেন অন্তত ১৫ জন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তারা দলবল নিয়ে এলাকায় ঘোরাফেরা করায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আসনটির স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল ও প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল দেওয়ার জন্যও ভোটারদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ এসব তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জেলা রিটার্নিং কার্যালয়ে অন্তত ২৫টি অভিযোগ করেছেন। একই সাথে এই আসনে সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৬ ডিসেম্বর যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের দাড়িপাড়া, দারোগার মোড় এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহিত কুমার নাথের প্রচার মাইকিং চলছিলো। এ সময় ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের কর্মী সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান জিসানের নেতৃত্বে ঈগলের প্রচার মাইক থামিয়ে টেনে হিঁচড়ে ইজিবাইকের চালককে নামিয়ে হুমকি ও মারমুখি আচরণ করে। এসময় তারা বলেন এই ইউনিয়নে ঈগলের কোন প্রচারণা চলবে না। নৌকা প্রতীকের কর্মী জিসানের এই আচরণ আগামি ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহনের দিন সাধারণ ভোটারদের উপস্থিতিতে প্রভাব পড়বে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, জিসান পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। সম্প্রতি প্রকাশ্যে অস্ত্র উঠিয়ে ফূর্তি করা তার একটি ভিডিও আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। যেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এমন পরিস্থিতি জিসান বাহিনীর কারণে এই ইউনিয়নে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ জানিয়েছেন, তার নির্বাচনী এলাকার ভোটের পরিবেশ নষ্ট করছে চিহ্নিত কয়েক সন্ত্রাসী। ঈগল প্রতীকের ক্যাম্প ভাঙচুর করা হচ্ছে। একের পর এক হামলাও চালানো হচ্ছে। দ্রুত এই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজী নাবিল আহমেদের সাথে প্রচারণার মাঠে রয়েছেন যশোর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়ন। যার বিরুদ্ধে খুলনার ট্রাক চালক ও হেলপার, যশোরের ইজিবাইক চালক রেলগেটের রুবেল ও শংকরপুরের হৃদয়সহ অন্তত ডজনখানেক হত্যা মামলা রয়েছে। শুধু তাই নয় অস্ত্র, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, জমি দখলসহ আড়াই ডজন মামলা রয়েছে। নয়নের নামে জেলা পরিষদের গাছ চুরির অভিযোগে মামলাও রয়েছে। শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী নয়নের প্রধান পেশা চাঁদাবাজি। রাজনীতি ওর তকমা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জায়েজ করতে যশোর পৌরসভা নির্বাচনে ৭ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছিলেন। অনেক প্রার্থী ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাতে এবং স্থানীয় সংসদের অনুসারী হওয়াতে অল্প ভোটে বিজয়ী হন তিনি। কাউন্সিলর হয়েও এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেমে নেই। এলাকায় গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং। আসন্ন নির্বাচনে এইসব চিহ্নিত কিশোর গ্যাং নিয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন।
যশোর জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন মিলন। যশোর পৌরসভার ৪ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হলেও পুলিশের খাতায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার নামে হত্যা, চাঁদাবাজির ডজনখানেক মামলা আছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে যুবলীগ কর্মী শরিফুল ইসলাম সোহাগ খুন হওয়ার পর এক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পরিকল্পনাকারী হিসেবে মিলনের নাম আসে। ২০১৯ সালে কাজী নাবিলের বাড়িতে বোমা হামলাও তার নেতৃত্বেই চালানো হয় বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে ইজিবাইক ও ট্রাকে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হলেও ছয় মাসের মাথায় তিনি জামিন পেয়ে যান। এক সময়কার যশোরে ক্যাসিনোকাণ্ডের প্রধান হোতা ছিলেন মিলন। নিজের প্রভাব বিস্তার করতে এলাকায় কিশোরদের নিয়ে তৈরি করেছেন কিশোর গ্যাং। যা ইতোমধ্যে নির্বাচনে প্রভাব ফেলাচ্ছেন তিনি। এইসব কিশোর গ্যাং নিয়ে শহরে নৌকার প্রচারণা করছেন তিনি। অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এজাহারে কোথাও আমার নাম ছিল না। জবানবন্দিতেও আমার নাম আসেনি। বিভিন্ন মামলায় রাজনৈতিকভাবে আমাকে জড়ানো হয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ বলেছেন, ‘এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী টানা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকায় তেমন উন্নয়ন করেনি। একই সাথে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নেই। নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করায় ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নেই। যখন আমার বিজয়ের পাল্লা ভারি হতে চলেছে; তখনই আমার কর্মী সমর্থকদের প্রতিনিয়ত হামলা হুমকি, প্রচারণাতে বাধা দিচ্ছে। এছাড়াও সমর্থক ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও রাতে ভয় ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নৌকার প্রতীকের প্রার্থী ক্যাডার নির্ভর হয়ে পড়েছেন। এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ২৫টি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাজী নাবিলের মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেনি। তবে তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহিত নাথের সব বানানো কথা। নিজেকে জনসম¥ুখে জাহির হওয়ার জন্যে এসব করছে। আমাদের এমপি সাহেব (কাজী নাবিল) বলে দিয়েছেন, শুধু মোহিত নাথ না, কারো নির্বাচনী প্রচারে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না। আমরা কাউকে কোনো বাধা দিচ্ছি না’।
তিনি বলেন, ‘বিতর্কিত বলে কিছু নাই। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সবাই জনপ্রতিনিধি। তারা অনেকেই জামিনে আছে বা দোষী প্রমাণিত না হওয়ার সুস্থ রাজনীতি করছে’।
জানতে চাইলে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাদের নামে মামলা রয়েছে; তবে সবাই জামিনে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করছে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই আমাদের কাছে। তবে তারা পুলিশের নজরে রয়েছে।
পুলিশের সূত্র বলছে, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের পক্ষে তদবির করায় ইদানিং কাজী নাবিলের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখে চলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কাছে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। যেসব অভিযোগ আসছে তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়েও নজর রাখা হচ্ছে। কোন ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনে অভিযোগ তদন্ত করতে ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি নির্বাচনী আচরণবিধি প্রার্থীরা মেনে চলছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে।
প্রসঙ্গত, যশোর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাজী নাবিল আহমেদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ। এই আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে লড়াইয়ের আভাস মিলছে। এই আসনে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মারুফ হাসান কাজল, জাতীর পার্টির মাহবুব আলম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির অ্যাড. সুমন কুমার রায়, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো: তৌহিদুজ্জামান, তূণমূল বিএনপি মো. কামরুজ্জামান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের শেখ নুরুজ্জামান।