এম আর মাসুদ, ঝিকরগাছা
মহাসড়ক থেকে নেমে কাঁচারাস্তা দিয়ে মিনিট তিনেক যেতে কানে ভেসে এল ‘আমাদের দেশ আয়তনে ছোট হলেও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য খুবই সমৃদ্ধ’। এর খোঁজে রাস্তা বেয়ে একটু এগিয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল প্লাস্টিকের মাদুরের ওপর বসে আছে ২০-২২ জন নারী-পুরুষ। তারা সবাই কৃষক-কৃষাণী। তাদের হাতে রয়েছে খাতা-কলম। সামনে রাখা আছে নিমপাতা, নিমবীজ, মেহগনি বীজ, তামাক পাতা, বিষকাটালি (ঢোল কমলি) টমেটো গাছ, কালো কচুর পাতা, আতা (শরীফার) পাতা, শুকনা মরিচের গুড়া, পাট বীজ, পেঁয়াজ, নিশিন্দা পাতা, ইপিল ইপিল পাতা, পেঁপে পাতা, গাঁদা ও জবা ফুলের পাতা এবং বোর্দো মিকচারের উপকরণ। এসব দিয়ে ভেষজ বালাইনাশক প্রস্তুতপ্রনালী ও ব্যবহার তাদেরকে শেখাচ্ছেন আইয়ুব হোসেন।
কৃষক-কৃষাণীর ভেষজ বালাইনাশক স্কুলটিতে বিনে পয়সায় সপ্তাহে এক দিন, দুই ঘণ্টা করে শেখানো হয়। দেখে মনে হলো, স্কুলটিতে যারা আছেন, তাদের সবাই সরাসরি কৃষি কাজের সাথে জড়িত। ৫ মাস আগে শুরু করা স্কুলটি এ মাসে শেষ হবে। স্কুলটি যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী ইউনিয়নের বেনেয়ালী গ্রামের দীঘিরপাড় এলাকায়। স্কুলগুলোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া আইয়ুব হোসেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় সবজি ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা স্কুল রয়েছে উপজেলায় ৬টি। প্রতি স্কুলে ২৫ জন করে কৃষক-কৃষাণী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সবজি ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি স্কুলগুলোতে শেখানো হয়, ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের পরিচিতি, উপকারী পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণ কৌশল, উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে, ভেষজ বালাইনাশক তৈরীর কলাকৌশল ও ফসল ক্ষেতে প্রয়োগ, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার কলাকৌশল, মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসমূহ ব্যবহার কলাকৌশল, কীটনাশকের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিমুক্ত ব্যবহার সম্পর্কসহ নানা বিষয়াদি।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন কৃষকদের সাথে আলাপ হয়। বেনেয়ালী গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জৈব বালাই নাশক বায়োক্লিন ব্যবহার করায় আমার পটল ক্ষেতে কোন বন্ধু পোকা মারা যায় নাই। সে কারণে শত্রু পোকা দমন রয়েছে। এতে করে আমার পটল ক্ষেতে খরচ কম হয়েছে, আবার ফলন বেশি হয়েছে।
কানাইরালী গ্রামের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ছত্রাকজনিত রোগে আমার বেগুন গাছের গোড়ার ছাল নষ্ট হওয়ায় বর্দোমিক্সার ব্যবহার করে ভালো ফলন পেয়েছি। এ বিষয়ে আমি বালাইনাশক স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম।
বোধখানা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, বেগুন ও টমেটো ক্ষেতে জৈব বালাইনাশক ও হলুদ ফাঁদ, সেক্সফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেছি। কোনো রাসায়িক কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি। রাজাপুর গ্রামের বিলকিস বেগম বলেন, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জৈব সার ব্যবহার ও জৈব সার তৈরির কলাকৌশল শিখে সেটা ব্যবহার করায় ভালো ফলন পেয়েছি। লক্ষীপুর গ্রামের তরিকুল ইসলাম বলেন, সব পোকাই শত্রু নয়। বিষয়টি আইপিএম স্কুল থেকে জেনেছি। এই নীতিতে এ বছর ধানের জমিতে কোনো কীটনাশক ব্যবহার না করে শত্রু পোকার আক্রমণ রোধ করতে পেরেছি।
২০১৬ সালে বিষমুক্ত (নিরাপদ) সবজি উৎপাদনে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত কৃষক বোধখানা গ্রামের আলী হোসেন বলেন, এ প্রশিক্ষণে কিভাবে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও আদর্শ বীজতলা তৈরি ও ফলন বাড়াতে লাইন লোগো পদ্ধতি, ক্ষতিকর পোকা দমনে পার্চিং, সেক্সফেরোমন ফাঁদ, পোকার উপস্থিতি নিরুপনে আলোক ফাঁদসহ জৈব বালাইনাশক ব্যবহার শেখানো হয়েছে।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্ত আইয়ুব হোসেন বলেন, পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় সবজি ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ৬ টি স্কুলে ১৫০ জন কৃষক-কৃষাণীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা। যেটা আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এ স্কুলে জৈব বালাইনাশক তৈরির পদ্ধতি কৃষকদের শেখানো হয়। মাসুদ হোসেন পলাশ আরও বলেন, আইয়ুব হোসেন একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সারাদেশের ‘বেস্ট আইপিএম’ সহায়তাকারী। এজন্য তিনি ২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেন সরকারিভাবে। গত বছর তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ২০২২ এ মনোনিত হয়েছেন। তিনি এ প্রশিক্ষণ দেন।
