নিজস্ব প্রতিবেদক
ক্ষমতার ‘কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে আলোচিত যশোর শহরের ‘শাহেদ সেন্টারে’ এখন সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। যশোর শহরের রাজনীতিতে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ কাজী নাবিল আহমেদ ও তার কর্মচারীদের ‘হোয়াইট হাউজ’ খ্যাত এই নিরাপদ স্থানটি এখন সবসময় থাকছে তালাবদ্ধ। সেখানে সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ তো বটেই, তার পিএস সুজন সাত্তার ও অন্যান্য কর্মচারীদের গত সাড়ে ৪ মাসে একদিনের জন্যও দেখা মেলেনি।
যশোর শহরের কাজীপাড়ায় অবস্থিত ‘শাহেদ সেন্টার’। যশোর-৩ আসনের সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ এখানে বসে ব্যক্তিগত কর্মচারীদের দিয়ে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরিচালনা করতেন। কাজী নাবিল মূলত ঢাকায় থাকতেন; মাঝেমধ্যে যশোরে বেড়াতে এসে শাহেদ সেন্টারে বসে হুকুম জারি করতেন। সেই মোতাবেক চলতে হতো আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। তার অবর্তমানে পিএস সুজন সাত্তার ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কর্মচারীরা ছিলেন হর্তাকর্তা! যাদের কাছে প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন অসহায়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট যশোরে ছিলেন যশোর-৩ আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। এদিন বিকালে তিনি সারা দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। এরপর আর যশোরে দেখা যায়নি নাবিল ও তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলে সারাদেশে হত্যা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের বহু নেতা আত্মগোপনে যান। এসময় কাজী নাবিল আহমেদ ও তার পিএস সুজন সাত্তার ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যান। এরপর হাতেগোনা দুই-একজন ছাড়া নেতাকর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই।
নেতাকর্মীদের ভাষ্য, গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর শাহেদ সেন্টার ফাঁকা হতে শুরু করে। বিকালে তালা দেয়া হয় মূল ফটকে। সেই থেকেই তালাবদ্ধ রয়েছে ‘ক্ষমতার এই কেন্দ্র বিন্দুটি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা হোয়াটসঅ্যাপে জানান, ২০১৪ সালে যশোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে রাজনীতিতে ‘উড়ে এসে জুড়ে’ বসে কাজী নাবিল আহমেদ। এসময় জেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কিন্তু দল মনোনয়ন দেয়ায় শেষ পর্যন্ত চুপচাপ হয়ে যায় ওই পক্ষটি। কাজী নাবিল বিনা ভোটে এমপি হয়ে যান। এরপর তিনি শাহেদ সেন্টারে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। যশোরে যখন থাকতেন তখন তার অনুসারী নেতাদের শাহেদ সেন্টারে হাজিরা দেয়া লাগতো। যদিও পিএস সুজন সাত্তার ও কর্মচারীদের অনুমতি ছাড়া কাজী নাবিলের সাক্ষাৎ পাওয়া দুষ্কর ছিল। এতো গেলো সাক্ষাৎ পাওয়া। দান-অনুদান কিংবা টিআর বরাদ্দ পেতে পিএস সুজন সাত্তার ও কর্মচারীদের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। তাদের ম্যানেজ করতে পারলে ছিটেফোটা বরাদ্দ পাওয়া যেতো। এছাড়া অনেক বরাদ্দ কর্মচারী, তাদের আত্মীয় স্বজনের নামে দেয়া হতো। যার একটি কমিশন যেত সুজন সাত্তারের পকেটে। কিন্তু কাগজ-কলমে প্রমাণ না থাকায় কেউ প্রতিবাদ করতে পারেননি।
নেতাকর্মীরা আরো জানান, শাহেদ সেন্টারে বসে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে এই ভাগবাটোয়ারা হতো সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথের হাত ধরে। পরে দায়িত্ব পান সে সময়ের সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান মিন্টু। এই দুই নেতা মাঠ পর্যায়ে কিছু কিছু বরাদ্দ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুবিধা হচ্ছিল না শাহেদ সেন্টারের ক্ষমতাধরদের। ফলে পুরো দায়িত্ব নেন পিএস সুজন সাত্তার। এরপর তিনি লুটপাট করতে থাকেন দুই হাত দিয়ে। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার কিছুই হয়নি। আর জেল খাটছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মাঠের কর্মীদের দুর্দিনে নাবিল ও সুজন সাত্তার আত্মগোপনে থেকেও আছেন রাজারহালে।