একই দিনে বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস
ও স্বরস্বতী পূজা হওয়ায় বাজার চাঙ্গা
ভালো দামে চাষির মুখে খুশির ঝিলিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ফেব্রুয়ারি তিন দিবস ঘিরে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীর চাষিরা আশার আলো দেখছেন। ইতিমধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফুলের বাজার চাঙ্গা হয়ে গেছে। অধিকাংশ ফুলের দাম প্রায় তিনগুন বেড়েছে। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষির মুখে খুশির ঝিলিক বইছে। আগামী দুই দিনে আরও দাম বাড়বে বলে চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান।
এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের স্বরস্বতী পূজা। এসব দিবস ঘিরে গোটা দেশেই প্রচুর ফুলের চাহিদা থাকে। যার সিংহভাগ সরবরাহ যশোরের গদখালী থেকে। আর এ মাসেই রয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ফলে চলতি মাসে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্যের স্বপ্ন দেখছেন গদখালী এলাকার চাষিরা।
রোববারের বাজার ধরতে কাকডাকা ভোরেই চাষিরা বিভিন্ন যানবাহনে তাদের উৎপাদিত ফুল নিয়ে আসেন ফুলের পাইকারি মোকাম গদখালীতে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠে ফুলবাজার। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দু’ধারে বিভিন্ন জাতের ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেন কৃষকরা। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল, মোটরসাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
এদিন গদখালী বাজারে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে যা বিক্রি হয়েছে ৯ থেকে ১১ টাকায়। প্রতি পিস রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ১৪-১৬ টাকায়, যা আগে ছিল ৮-১০ টাকা। রঙিন গ্লাডিওলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১৮ থেকে ২২ টাকা, যা আগে ছিল ৮-১০ টাকা। জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। তবে জারবেরার দাম খুব বাড়েনি। এক সপ্তাহে আগে বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকায়। কৃষক বলছেন, এবছর জারবেরার উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম প্রায় অপরিবর্তিত আছে।
এদিকে ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি আঁটি ২৫ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়। যা আগে ছিল ২০-২৫ টাকা। মালা গাঁথার জন্য চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি হয়েছে প্রতি ১০০ ফুল ২৮০ টাকা। গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে প্রতি হাজার ৩৫০-৩৮০ টাকায়, যা আগে ছিল ১২০-১৫০ টাকা। লিলিয়াম প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা। তিনদিন আগেও যার দাম ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা।
পানিসার গ্রামের কৃষক আসাদুল ইসলাম আসু বলেন, প্রায় ১০ কাঠা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি। গত সপ্তাহে গোলাপের দাম ছিল ৮-১০ টাকা। আজ ২২ টাকা পর্যন্ত দাম পেয়েছি। তিনি বলেন, বিশেষ করে বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপের চাহিদ খুব বেশি থাকে। তাই এর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু দিন আগে গোলাপে পচন রোগ দেখা দেয়ায় উৎপাদন একটু কমেছে। কিন্তু দামে তা পুষিয়ে যাচ্ছে।
হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের আসলাম হোসেন ৪০০ পিস গোলাপ বিক্রির জন্য এনেছিলেন। তিনি বলেন, প্রতি ১০০ ফুল তিনি বিক্রি করেছেন ২৬০০ টাকা। তিনি বলেন, প্রায় দুই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি, এবছর পচন রোগের কারণে উৎপাদন কম। তবে দাম বেশি হওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
ফুল ব্যবসায়ী দেলোয়ার দিপু বলেন, বাজারে গোলাপের সংকট রয়েছে। ভালোবাসা দিবসের আগের বাজারে ৩৫ টাকায় ফুল পাওয়াও মুশকিল হয়ে যাবে।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, সারাবছর ফুল বিক্রি হলেও মূলত বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে বেচাকেনা বেশি হয়। এ মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বিশেষ করে গোলাপ ফুলের উৎপাদন কম হয়েছে। তবে আসন্ন তিন দিবসকে ঘিরে অন্তত ৫০ থেকে ৫৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা আশা করছি।
ঝিকরগাছা উপজেলার সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপঙ্কর দাস জানান, গদখালিতে ফুলের উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। তিনি আরও জানান, দেশের মধ্যে বাণ্যিজিকভাবে যশোর জেলার গদখালীতে ফুল উৎপাদন শুরু করা হয় আশির দশকে। দেশের ফুলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রয়েছে এখানে। ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা গদখালিতে আসেন ফুল ক্রয় করতে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, ঝিকরগাছা উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়ে থাকে। এরইমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও মহান স্বাধীনতা দিবস ঘিরে ফুলের বাজার ধরার জন্য স্থানীয় ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এবার ফুলের আবাদ ভালো হয়েছে, বাজারে দামও ভালো। এ কারণে এই দু’মাসে এই এলাকা থেকে শত কোটি টাকার ফুল সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি আর জানান, বিশেষ করে গদখালী, পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউবা, ফুলিয়া আর শার্শার নাভারণ, উলাশি, গদখালী ও শ্যামলাগাছি গ্রাম প্রায় বছরজুড়ে ফুলে ফুলে শোভিত থাকে। গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১৫ ধরনের ফুলের চাষ হয়। এখানে নতুন নতুন জাতের ফুলের চাষ করা হয়ে থাকে। গত বছর টিউলিপ ও লিলিয়াম ফুল চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন এখানকার চাষিরা। এ বছরও চাষ করা হয়েছে। আমরা চাষিদের সার, বীজসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি।