আব্দুল ওয়াহাব মুকুল
২০১০ সালে যশোরের নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘোষণার পর ২০১৪ সালের মে মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের যাচাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখেনি এই জনপদের মানুষ। এই পরিস্থিতির মধ্যে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি রেলমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আশার কথা শুনিয়ে রেললাইন নির্মাণে দুটি পিডিপিপি প্রণয়ণের কথা উল্লেখ করেন। আর গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে নাভারন-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত ও বাস্তবায়ন করতে সাতক্ষীরা জেলা সমিতি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সাথে দেখা করে দাবি জানায়। এভাবে নাগরিকদের দাবি ও জনপ্রতিনিধিদের চেষ্টা-তদ্বিরেও খুব বেশি নড়চড় হয়নি প্রকল্পের ফাইল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ১৩ বছর এবং প্রকল্প যাচাইয়ের ৯ বছর পরও অগ্রগতি দেখে হতাশ সুন্দরবন ঘেঁষা জেলা সাতক্ষীরাবাসী।
জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের শুধু আশ্বাসই শোনাচ্ছে মন্ত্রণালয়
যশোরের নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প
শ্যামনগরে প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড় আইলায় ক্ষত-বিক্ষত জনপদ গত ২০১০ সালের ১০ জুলাই পরিদর্শনে এসে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহাসিক ভাষনে এই রেল পথ নির্মাণের ঘোষণা দেন। এ অঞ্চলে মানুষের প্রাণের দাবির প্রতি সম্মান দিয়ে, বাস্তবতা উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া এই ঘোষণা ওই এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এই রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে সুন্দরবন এবং প্রত্ননিদর্শন দেখা’র জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের গমনাগমন বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেলে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে পাশাপাশি মানুষের জীবনমান এর উন্নয়ন ঘটেেব।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঘোষনার পরপরই দ্রুত শুরু হয় জরিপ, স্টেশনের স্থান নির্ধারণ, ব্রিজ কালভার্টের স্থান নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় কাজ। বেশ তোড়জোড় করে এগুলো হলেও পরে আর দৃশ্যমান কোন কাজ এগোয়নি।
রেলপথ বিভাগ সূত্র মতে, সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের গ্যারেজ রাজার থেকে যশোরের নাভরণ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ-প্রকল্পের সেসময় প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিলো এক হাজার ৬৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নে ৩৩২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অবশিষ্ট এক হাজার ৩২৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকার জন্য বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়ন খোঁজা হচ্ছে। সেসময় প্রকল্পটির মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ২০২৪ সাল পর্যন্ত। কিন্তু মেয়াদকাল আর দেড় বছর থাকলেও প্রকল্পই একনেকে অনুমোদন হয়নি। ফলে কার্যাদেশ থেকে বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের কথা।
উল্লেখ্য, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছর শেষ। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে এই প্রকল্প কাজ অন্তর্ভুক্ত করানোর ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার মানুষ ইতিমধ্যে সোচ্চার হয়েছিলো যথেষ্ট, কিন্তু তা কোন কাজে আসেনি।
রেলপথ বিভাগের ওই সূত্রটি জানায়, নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত থাকবে আটটি স্টেশন। এগুলো হলো নাভারন, বাগআঁচড়া, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, পারুলিয়া, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর ও মুন্সীগঞ্জ। একইসঙ্গে রেলপথের সেতু নির্মিত হবে বাঁকাল, লাবণ্যবতী, সাপমারা খাল ও কাকশিয়ালী নদীর ওপর।
সাতক্ষীরার অন্যতম কৃষিজ সম্পদ যেমন, ‘সাদা সোনা’ (চিংড়ি), সুন্দরবনের মধু, আম, কুল, বঙ্গপোসাগর উপকূলীয় নদ-নদীর এবং ঘেরের সাদা মাছ, সুন্দরবনের কাঠ ও নানা রপ্তানিযোগ্য সমৃদ্ধ সম্পদ রয়েছে এই জনপদে। রেলপথ হলে এসকল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার হবে। ব্যাপক হারে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকার গতি বাড়বে। স্থলবন্দর ভোমরারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়বে।
বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন সাতক্ষীরা জেলার প্রধান আকর্ষণ। কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অসংখ্য ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। যা দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুদেরকে আকর্ষণ করে।
সাতক্ষীরা-৪ শ্যামনগর আসনের এমপি এস এম জগলুল হায়দার বলেছেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দেন তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করেন। তিনি বলেছেন, মুন্সিগঞ্জের গ্যারেজ রাজার থেকে যশোরের নাভরণ পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ দ্রুতই চালু হবে বলে রেলমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন।
শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন বলেছেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা এ উপজেলা মানুষের দুঃখ কষ্ট বোঝেন বলে এই প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এ অঞ্চলে মানুষের জীবনমান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই রেলপথ নির্মাণ খুব দ্রুত শুরু হওয়া দরকার।
শ্যামনগর উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জহুরুল হায়দার বাবু বলেছেন, দ্রুত এই রেলপথ নির্মাণ হলে উন্নয়নে পিছিয়েপড়া উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরে শুরু হয়ে যাবে মহাকর্মযজ্ঞ। খুলে যাবে কর্মসংস্থানের দরজা। তিনি আরো বলেন, জনসভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে ১৭টি বাস্তবায়ন হয়েছে। এই রেলপথ নির্মাণ শুরুর বিষয়ে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন যশোর-সাতক্ষীরার মানুষ।