জাহিদ হাসান
ঋতু চক্রে চলছে বর্ষাকাল। এসময় ঝুম বৃষ্টি নামার কথা। অথচ বর্ষার ৭ দিন পার হলেও বৃষ্টির পরিবর্তে দেখা দিয়েছে তাপদাহ। অথচ বিগত ১০ বছর আগে আষাঢ় শুরুর আগেই একশ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেও এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ২০ মিলিমিটারে। এবারের মৌসুমে দাঁড়িয়েছে ১৬ মিলিমিটারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা পাল্টেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে এবং শীত ঋতুতেও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা অক্ষুন্ন থাকছে। এ জন্য অসময়ে বেশি বৃষ্টি এবং মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এতে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি ও কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, যশোর ও রাজশাহী দেশের ‘চরম আবহাওয়া’ প্রবণ জেলা। দেশে সবচেয়ে বেশি দিন গরম থাকে যশোরে। এই জেলায় বছরে গড়ে ৭৫ দিন আবহাওয়া বেশি উষ্ণ ছিল, যা রাজশাহী (৬৭ দিন) ও ঈশ্বরদীর (৫৮ দিন) চেয়ে বেশি। রাজশাহীতে বছরে ১৫৫ দিন শীত অথবা গরম বেশি ছিল। যশোরে তা ১৫৩ দিন। এর পরে রয়েছে ঈশ্বরদী, ১৪৫ দিন। আবহাওয়া অধিদপ্তর বছরের যেসব দিনে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা থাকে, সেসব দিনকে চরম আবহাওয়ার তালিকায় রাখে। আর ১৫ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা থাকলে সেই দিনকেও রাখা হয় চরমের তালিকায়। ভুগোল ও পরিবেশবিদদের ভাষ্য মতে, ‘দেশে মার্চ-এপ্রিলে গরম বাতাসের একটি প্রবাহ প্রবেশ করে। আগে এর মূল কেন্দ্রটি পাবনার ঈশ্বরদী এলাকা দিয়ে ঢুকে রাজশাহী বিভাগে বেশি দিন অবস্থান করত। সাম্প্রতিককালে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে। বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের প্রবেশের পথ কিছুটা বদলে যাচ্ছে।
আবহাওয়ার গরম চাপকোষটা বিরাজ করে মূলত মধ্য ভারতে। সেটা প্রতিবছরই ভারতে সবসময় সংক্রিয় থাকলেও বাংলাদেশে থাকে না। শুধুমাত্র যশোরের চৌগাছা থেকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর পর্যন্ত সামান্য অংশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রভাব ফেলে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে পূর্বদিকে আরো সম্প্রসারিত হয়ে নড়াইল পর্যন্ত বিস্তার ঘটেছে। স্থল নিম্নচাপ দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত যশোর অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হবে।
প্রফেসর ছোলজার রহমান, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, এম এম কলেজ
দীর্ঘদিন ধরে যশোর অঞ্চলের পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেছেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় (এম এম কলেজ) ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ছোলজার রহমান। তিনি বর্তমানে যোগদান করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। তিনি দৈনিক কল্যাণকে জানান, ‘আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব সেটা পড়তে শুরু করেছে। যা আগামি একদশক পর্যন্ত এই প্রভাব পড়বে। এই সময়ে আবহাওয়ার গরম চাপকোষটা বিরাজ করে মূলত মধ্য ভারতে। সেটা এবার প্রবাল শক্তিশালী হয়ে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে শক্তিশালী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থায়ী রুপ ধারণ করেছে। চাপকোষটা প্রতিবছরই ভারতে সবসময় সংক্রিয় থাকলেও বাংলাদেশে এতোটা সংক্রিয় থাকে না। শুধুমাত্র যশোরের চৌগাছা থেকে চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর পর্যন্ত সামান্য অংশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রভাব ফেলে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে পূর্বদিকে আরো সম্প্রসারিত হয়ে যশোর নড়াইল পর্যন্ত বিস্তার ঘটেছে। স্থল নিম্নচাপ দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত যশোর অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হবে। আঞ্চলিক প্রভাবও এই জলবায়ুটাকে প্রভাব ফেলেছে। যেমন উন্নয়নের নামে আমরা যে গাছ বিনষ্ট করছি সেটাও জলবায়ু বিরূপ পরিস্থিতির অন্য একটি কারণ। এছাড়া এ অঞ্চলের যত নদ নদী রয়েছে সেগুলো শাসনের নামে প্রবাহহীন ও পানিহীন করে ফেলেছি। নিম্নভূমি জলাশয় প্রতিনিয়ত ভরাট করে করে স্থলভাগে পানি শূন্য করে ফেলছি। এসব সামগ্রিক প্রভাবে ভূস্থলে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে বায়ুমন্ডলে আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। এটার প্রভাব কৃষিতে সরাসরি প্রভাব পড়বে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়া কথা ৮০ মিলিমিটার; যেখানে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ মিলিমিটার। জুনে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা সাড়ে ৪ শ’ মিলিমিটারের উপরে। কিন্তু জুনের ২১ দিনে ১৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাধারণ জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত বৃষ্টি হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে জুলাই মাসে সাড়ে চারশ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে তিনশ মিলিমিটারের মতো। এছাড়া গত পাঁচ বছরে আগস্টে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৩৭০ মিলিমিটার; হয়েছে ২৫০ মিলিমিটার। সেপ্টেম্বরে দুইশ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে দেড়শ মিলিমিটার। পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত মার্চ থেকে চলতি জুন পর্যন্ত যশোরে ৩৩ থেকে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি পর্যন্ত সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে অধিক তাপমাত্রার এমন চিত্র আগে কখনো অনুভূত হয়নি বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। দিনের বেলা তপ্ত রোদ। গরমের দাপট কমেনি রাতেও। যদিও চলতি মাসের এই সপ্তাহ থেকে বৃষ্টিপাত না হলেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকাতে তাপদাহ কিছুটা কমেছে।
শুধু আবহাওয়াগত কারণেই যশোর অঞ্চলের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে, তা নয়। এর সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাওয়া ও গাছপালা কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন প্রফেসর ছোলজার রহমান। তিনি জানান, যশোরের একটি অংশজুড়ে একসময় সুন্দরবন বিস্তৃত ছিল। নদী বেশি ছিল, পানিপ্রবাহ বেশি ছিল। এখন বন নেই, নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে। জেলাটির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাতটি নদীর মধ্যে মাত্র দুটি এখনো কোনোমতে খরস্রোতা হয়ে টিকে আছে। ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদ মৃতপ্রায়। কপোতাক্ষ, শ্রীহরী, টেকা, বুড়িভদ্রাসহ অন্যান্য নদ নদীর পানিপ্রবাহ কমেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু বদলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে আমরা যদি যশোর-খুলনার মতো উপকূলীয় এলাকায় নদীর পানি প্রবাহ বাড়াতে পারি, সেখানে বনভূমি রক্ষা ও গাছপালা বাড়াতে পারি, তাহলে বৃষ্টিপাত বেড়ে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমানো যাবে।
পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়াতে বিপাকে পড়ছে এই অঞ্চলের চাষিরা। অনেকে গভীর-অগভীর নলকূপ চালু করে ক্ষেতে সেচ দিয়ে হাল চাষ করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, পর্যপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়াতে কৃষি আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত না হওয়াতে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে; ফলে এই তাপমাত্রা কৃষি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফসলের চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এমন চলতে থাকলে চাষাবাদে বিলম্ব হবে। বৃষ্টিপাত কমার কারণে কৃষিখাতে ভূগর্ভস্ত পানির ব্যবহার বাড়ছে; এতে যেমন কৃষি খাতে খরচ বাড়ছে অন্যদিকে পানির লেয়ার দিনকে দিন কমে যাচ্ছে।

 
									 
					